বামুনঠাকুরের কথা শুনে অমিত কে নিয়ে বেরিয়ে পরে নরেন কাকা জঙ্গীপুরের উদ্দেশ্যে। ফটোগ্রাফির ভুত কবে নেমে গেছে অমিতের ঘাড় থেকে। এখন মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন খিল দিচ্ছে কেন যে এসব ভুতুড়ে জায়গায় এলো? যেমন করেই হোক সুমনককে বাঁচাতে হবে। নরেন আগেও প্রয়োজনে দুবার এসেছে শালুবুড়ির কাছে।
আসুন তবে শালুবুড়ি নিয়ে কিছু জেনে নেওয়া যাক।
জঙ্গীপুরের কাছে আহিরন গ্রামেই থাকেন সৈয়দ সালমা বেগম। লোকে তাকে শালুবুড়ি নামেই চেনে। বয়স প্রায় ষাট ছুই ছুই। বছর পনেরো আগেই পীর স্বামীর নিধন হয়েছে। আহিরন গ্রামের কাছেই একটা ছোট্ট জায়গায় ওনার দরগাহ। গ্রামের লোক তাকে পীর মা বলেই সম্বোধন করে।
রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা, বহরমপুর, ধুলিয়ান, ফারাক্কা, কালিয়াচক এলাকার লোক তাকে এক নামেই চেনে। তার অদ্ভুত অদ্ভুত কীর্তির কথা কে না জানে। পীর বাবার কাছেই দীক্ষা লাভ করেছেন তিনি। কোরানের সব কঠিন কঠিন আয়াত এবং দুস্পাঠ্য সুরা তাঁর ঠোঁটস্ত।
দুস্পাঠ্য এজন্য বললাম, ইসলাম পুরানশাস্ত্রে এমন এমন কিছু সুরা বা মন্ত্র আছে যে গুলো সঠিক নিয়ম অনুযায়ী পাঠ না করলে ফল বিপরীত অথবা ভয়ঙ্কর হতে পারে। উদাহারণস্বরুপ আয়তাল কুরছি সুরা। এই সুরাটি তিন বার পাঠ করলে জিন, ভুত, প্রেতাত্মা অথবা যে কোনো অলৌকিক শক্তি ভস্ম হয়ে যাবে। তবে এটাকে পাঠ করার জন্য পবিত্র দেহ এবং মনের অধিকারী হতে হবে। আর এই সুরাটি উলটো অক্ষরে কেউ যদি পাঠ করে তাহলে যে বা যিনি পাঠ করছে, তিনি নিজেই তীব্র আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাবেন। হিন্দু শাস্ত্রে হনুমান চাল্লিশার যা মাহাত্ম্য, ইসলাম শাস্ত্রে আয়তাল কুরছির মাহাত্ম্য এক।
যাই হোক, আপনাদের পুরানের কথা বলতে বলতে নরেন কখন যে পৌছে গেছে বুঝতেই পারিনি।
দরগাহটা একদম ফাঁকা জায়গায় অবস্থিত। চারিদিকে খাঁ খাঁ মাঠ। গ্রাম থেকে প্রায় দু কিলোমিটার বাইরে NH -34 এর কাছে একলা পড়ে আছে এক চিলের দরগাহ। দরগাহর চার পাশে দশ-বারো টা শিশু গাছ যেন দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে । কাছাকাছি একটা দোকানও নেই।
ছোট্ট মাজারের চৌকাঠে পা রাখতেই একটা ভারী গলার শব্দ শুনতে পায় তারা।
"--না পাক শরীরে দরগাহতে প্রবেশ করবি না। ওইখানে ওজু করার জল আছে। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে আয়।"
সামনেই দাঁড়িয়ে কালো বোরখা পরিহিতা, চোখে চওড়া করে সুর্মা দেওয়া অসম্ভব সুন্দরী এক প্রৌড়া। তাকে কোনো ভাবেই দেখে বলা যাবে না যে ইনি ষাট বছর বয়সী। বোরখার ভেতর থেকে কাঁচা পাকা চুল গুলো উঁকি মারছে, চোখে অদ্ভুত এক আকর্ষন এবং আত্মবিশ্বাসের ছাপ।
অমিত কিছু বুঝে ওঠার আগেই নরেন কাকা তাকে চোখের ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করলেন, ইনিই হচ্ছে সেই শালুবুড়ি।
হাত মুখ ধুয়ে দরগাহর ভেতরে প্রবেশ করতেই শালুবুড়ি বলে উঠলেন,
"--কাল যেটা হয়েছে হয়েছে মোটেই ভালো হয়নি। ওই ছোঁরার কুঠির কাছে যাওয়া উচিত হয়নি। তার ওপর জায়গাটাকে অপবিত্র করেছে আবার। অন্যায় করেছে ও। দেড়শ বছরের পুরোনো শক্তিশালী জিন কে মুক্ত করেছে ওই ছোকরাটা।"
কথাগুলো শোনা মাত্রই তাঁর চরনে ষাষ্টাঙ্গ প্রনাম করে কান্নার সুর ধরে অমিত।
--"রক্ষা করো মা। আমাদের চরম বড় ভুল হয়েছে ওই ঘরটায় ঢুকে। আমার বন্ধুর প্রান এখন আপনার হাতে"
অমিতকে ঘাড় ধরে উঠিয়ে আশ্বাসন দেন পীর মা।
--"এখন যা যা বলছি সেটা করবি" বলেই একবাটি জলে নিয়ে সেটাতে বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র পড়া শুরু করেন তিনি।
একটু অবাক হয়েই একে অপরের মুখে চেয়ে থাকে অমিত ও নরেন কাকা।
--"এখন যা। এই পানিটা বোতলে ভরে নিয়ে যা। আজ রাতে ঘুমাবার সময় ওই ছেলেটাকে খাইয়ে দিস। আর সব থেকে বড় কথা, ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখিস আজকের দিনটা। আমার কিছু কাজ আছে। কাজ মিটিয়েই আমি কাল আসব ওখানে। "
আমরা অনেকে জলপড়া র নাম শুনেছি। অনেক তান্ত্রিক, মৌলবি আছেন যারা রোগ নিবারনের জন্য বিশেষত দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই জলপড়া আত্মা শুদ্ধিকরনের জন্যও অনেকে ব্যাবহার করেন। যাতে কোনো অশরীরী আত্মা বা প্রেত দেহের ওপর ভর না করতে পারে।
এই হচ্ছে সেই জলপড়া।
যাই হোক, তারা ওখান থেকে শালুবুড়ির দেওয়া জলপড়া নিয়ে চলে যায়।
বাড়িতে এসে অমিতের চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাড়ির দেওয়ালে সুমন কয়লা দিয়ে একের পর এক ছবি এঁকে যাচ্ছে। কিন্তু সুমন বাপজন্মেও কোনোদিন ছবি আঁকেনি। এত সুন্দর সুন্দর ছবি, যা না দেখলে বর্ননা করা যায় না, এটা কি করে সম্ভব? ভয়ে তটস্থ মামার বাড়ির লোক সুমনের কাছে ভিড়তে পারছে না।
দেওয়াল নোংরা হচ্ছে হোক, প্রানে বাঁচতে পারলেই হলো।
নরেন কাকার কথায় লক্ষীপন্ডিতের কাছে আবার ছোটে অমিত।
--"পন্ডিতমশাই, আপনি নিশ্চয় কিছু লুকোচ্ছেন। সুমনের এই হঠাত করে ছবি আঁকার অদ্ভুত প্রতিভা কোথা থেকে এলো?"
অমিতের কথায় হাড় হিম হয়ে যায় লক্ষীবামুনের। চমকে ওঠেন তিনি।
মাথায় কয়েকটা চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলেন,
--" তবে কি ঐ মহেন্দ্রনারায়ন...
--"কে মহেন্দ্রনারায়ন,? একটু খুলে বলবেন? ব্যাপারটা না জানলে এই সংকট থেকে পার পাওয়া মুশকিল পন্ডিতমশাই।"
--"তবে শোন হে বাছা।"
পুরো এক ঘটি জল গট গট করে খেয়ে বলা শুরু করলেন লক্ষীবামুন।
"আমার ঠাকুর্দার মুখে শোনা। আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা তখন এই জমিদার বংশের কুল পুরোহিত।
দ্বারকানাথ পুত্র মহেন্দ্রনারায়ন তখন নিমতিতা রাজবাড়ির জমিদার। কি তেজ না ছিলো তার। যেমন তার সুদর্শন চেহারা, তেমনি তার গ্রামের লোকেদের প্রতি দরদ।
সেই সময় এই মহেন্দ্রনারায়নের বেশ নাম ডাক ছিলো।
রাজ্যের তাবড় তাবড় জমিদারেরা এই নিমতিতায় আসতেন তাঁর কাছে। নাট্য অভিনয়ে বেশ পটু ছিলেন তিনি। বঙ্কিমচন্দ্রের বেশ কয়েকটি নাটক তিনি ঐ হিন্দু থিয়েটারে মঞ্চস্থ করে ছিলেন। ইংরেজ সাহেবদের সাথেও বেশ ভালো পরিচয় ছিলো তাঁর। তাঁর আমলেই শুরু হয় নিমতিতায় রেল পরিসেবা।
তবে অভিনয় ছাড়াও মহেন্দ্রনারায়নের আর একটা শখ ছিলো। অবসর সময়ে দুপুর বেলায় তিনি ছবি আঁকতেন।
দুর্গাপুজোর বিরাট মেলাতে হতো তাঁর আকা ছবির প্রদর্শনও। অনেক নামী নামী বড়লাটেরা চড়া দামে কিনতো তাঁর ছবি।
একবার মেলায় তার অঙ্কন প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিবাহ নিবেদন করেছিলো ওই মেয়েটি"
পন্ডিত মশয়াইয়ের কথায় বিঘ্ন ঘটিয়ে অমিত জিজ্ঞাসা করলো--"কোন মেয়েটি?
--"অপরুপ সুন্দরী রমণী। সাক্ষাত স্বর্গের কোনো অপ্সরার মতো। কেউ জানে না সে কোথা থেকে এসেছিল। নিজের নাম নয়নতারা জানিয়েছিলো সবাইকে।
তো তার সেই রুপে মুগ্ধ হয়ে বিবাহে ইতিবাচক ইশারা দেন যুবক জমিদার। জাত, গোত্রের বাচ বিচার না করেই খুব শীঘ্রই ওই অজ্ঞ্যাত পরিচয় কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে লিপ্ত হন তিনি।
নিমতিতার লোকেদের কানাঘুষি শোনা যায় রাস্থায় রাস্থায়, জমিদার নাকি বশীকরণের শিকার হয়েছেন।
কথায় বলে না, সত্য কখনো লুকোনো যায় না। সেদিন গভীর রাতে হঠাত ঘুম ভেঙে যাওয়ায় পাইচারি করার জন্য রাজবাড়ির বারান্দায় এসে জমিদার দেখতে পান নয়নতারা নামাজ পড়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন আঘাত করতে থাকে, তবে কি সে বিধর্মী কে বিবাহ করেছ?
ধর্মের প্রতি কোনো কালই বাচ বিচার করা তার অভ্যাস ছিলো না। কিন্তু মেনে নিতে পারেন নি নয়নতারার বিশ্বাসঘাতকতা। সে রাতে ঘুমাবার সময় একটা কথায় খটকা লেগেছিলো তাঁর। নামাজের পাঁচটি সময় তার জানা আছে কিন্তু মাঝরাতে তো কারোর নামাজ পড়ার কথা নয়। স্ত্রী কে কিছু না বলেই শুয়ে পড়েন তিনি।
পরের দিন ভোর বেলায় ঘুম ভাঙতেই ছুটে যান এলাকার সব থেকে জব্বর ওঝা বোরজান মোল্লার কাছে।
তাকে সব কথা খুলে বলতেই তিনি বলেন এ কোনো সাধারন মহিলা নয়। এ একটা শক্তিশালী জিন্নাত বা জিন। বোরজান ওঝা রাজবাড়িতে গিয়ে নয়নতারার আসল রুপের ব্যাপারে জানতে পেরে কি না কি সুরা অথবা কলমা পড়ে তাকে কুঠীবন্ধ করেছিলেন। আর একট সতর্কবানী হিসেবে কুঠী ঘেঁষে কাউকে মল মুত্র ত্যাগ করতে বারন করেছিলেন। তার পরে কোনোদিনো ওই জিনের উপদ্রব বোঝা যায়নি। কিন্তু এত দিন পরে আবার কি করে যে আবার ওই শক্তিশালী জিন জাগ্রত হলো বুঝতে পারছি না।"
গপ্পো বলতে বলতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি তারা। পেছন থেকে হঠাত একটা অদ্ভুত মানুষের মতো কণ্ঠস্বর।
--"হ্যা ঠিকই ধরেছিস পন্ডিত।"
চমকে গিয়ে পেছনে ঘুরে কাউকে দেখতে পায় না অমিত। কিন্তু যখনই নিচের দিকে তাকালো বুকের কলেজাটা উলটে যাওয়ার অভিপ্রায়।
অমিতের হাঁটুর থেকেও কম উচ্চতার একজন সাদা আলখাল্লা পড়া মাথাটাও সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা এক গাল বিশাল লম্বা দাড়ির মানুষ দাঁড়িয়ে যার মুখটা সুমনের আর দেহটা অন্যকারোর। সাথে খিল খিল করে হাসি।
"এবার আমি মহেন্দ্রকে ছাড়ছি না। তোরা হাজার চেষ্টা করেলেও আমাকে আটকাতে পারবি না। এবার আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।"
বলতে বলতেই বিদ্যুৎ গতিতে বাবুবাড়ির দেওয়ালে চেপে কোথায় যেন মিশে গেলো অদ্ভুত প্রানী টা।
******-*******
এরপর বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে গেছে। সুমনের বাড়ি থেকে ফোন এসেই চলেছে। সুমন কোথায় আছে কেউ জানে না। মামার বাড়ির লোক থানায় রিপোর্ট করেছে। কাল সুমনের বাড়ির লোকেরা আসবে এখানে।
ঘড়ি বলছে রাত একটা বাজে এখন। ধীরে ধীরে তন্দ্রায় বুজে আসছে অমিতের চোখ।
--"এ্যই অমিত, আমকে মিষ্টি খাওয়াবি? "
এতো খুব চেনা গলায় আওয়াজ অমিতের। হ্যা এতো সুমনের গলার স্বর।
আবার সেই একই গলা।
--" আমাকে একা ছেড়ে চলে গেছিস? এদিকে আয়? এখানে আইইইইইইইইইইইইইই।"।
কোথায় ডাকছে সুমন? অমিত যেন হেঁটেই চলেছে সুমনের পিছু পিছু গভীর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে।
ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারে এই তো সুমন নয়। ঘুম ভাঙছে না কেন? চোখ খুলেও বুঝতে পারছে সে এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে রয়েছে। অনেক শক্তি দিয়েও হাতা পা নাড়াবার চেষ্টা করলেও নাড়াতে পারছে না। এ তো নিশ্চয় ভুলো অথবা বোবার ঘোর।
এ ঘোর কাটতেই চাইছে না তার। তাকে যে করেই যে স্বপ্নটা ভাঙাতেই হবে।
দ্রুত গতিতে হেঁটেই চলেছে সুমনের পিছু পিছু। এমন প্রতীত হচ্ছে যে সময়ের বেগ কমে গিয়েছে।
হঠাত সুমনের সামনে একটা কালো বোরখা পরা মহিলা রুখে দাঁড়ালো। সাথে তীব্র বাজ পড়ার শব্দ।
অবাক কান্ড। এ তো শালুবুড়ি। অমিতের স্বপ্নের মধ্যে কি করে প্রবেশ করলো।
শালুবুড়ি ফিসফিস করে দু বার মন্ত্র পড়ে ফু দিতেই সুমন ছিটকে পড়ে গেল সজোরে। সাথেই সাথেই একঝটকায় ঘুম ভেঙ্গে চমকে বসে পড়লো অমিত। মাথাটা ডান দিকে ঘুরাতেই দেখে শালুবুড়ি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার চোখের দিকে। আর তাঁর পাশে ভয়ার্ত চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে নরেন কাকা এবং সুমনের মামার বাড়ির লোক জন।
--" পীর মা, আপনার তো কাল আসার কথা ছিলো। আপনি কি করে..
অমিতকে মাঝপথেই হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি,
--আশরাফ আমাকে সব বলেছে। আমকে যা করতে হবে এক্ষুনি করতে হবে। তোরা এক্ষুনি এক কাজ কর। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে একটা পরিস্কার নৌকা রেডি কর। আমি আসছি ওখানে। " বলেই শালুবুড়ি দু বার হাত তালি মারলেন আর সাথে সাথেই একটা হাওয়ার ঝটকা জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
ভয়ে প্রান শুকিয়ে গেছে অমিতের। আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। কে আশরাফ, কোন আশরাফ কিচ্ছু বোঝা গেলো না।
পীর মায়ের কথা মতো অমিতরা গঙ্গার ধারে একটা নৌকা পরিস্কার করে বসলো তার ওপর।
রাত প্রায় দু টো। জোৎস্নার আলো মেখে পবিত্র গঙ্গার জল ঝিক ঝিক করছে। কিছুক্ষন পরেই শালুবুড়ি এলেন নৌকার ওপরে। নৌকার একপাশে শালুবুড়ি সহ সবাই বসে আছে। এবার শালুবুড়ি আরবি ভাষায় পাঠ করতে শুরু করলেন কোরানের বাহাত্তর নম্বর সুরা। #সুরা_জিন।
থুরি, সুরা জিনের ব্যাপারে আপনাদের বলাই হয়নি।
সুরা জিন হলো কোরানের অন্যতম শক্তিশালি সুরার মধ্যে একটি। এটি সাতশো বার পাঠ করলে জিন কে নিজের বশে করা যায়। একশো থেকে দেড়শোবার পাঠ করলেই মানুষ খালি চোখে জিন দেখতে পায়। এ সুরা যে কেউ পাঠ করতে পারে না। সিদ্ধি লাভ করা কোনো ব্যাক্তির পক্ষেই এ সুরা পাঠ করা সম্ভব। অতীতে এটি পাঠ করতে করতে অনেকেই নিজেই ভস্মীভূত হয়েছেন। এই সুরা পাঠ করার জন্য যথার্থ সাহস থাকা চায়।
প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে। এখন প্রায় রাত তিনটে বাজে। শালুবুড়ির তীব্র গতিতে সুরা পাঠ চলছেই স্পষ্ট উচ্চারনে। হঠাত দেখা যায় নদীর তীরে সাদা জ্বল জ্বল করা গুটি কয়েক ছোট ছোট মানুষের মতো। উচ্চতা প্রায় দু ফুট হবে। মুখ গুলো ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না।
তাদের মধ্যে একজন নিজে থেকেই অমিতদের নৌকাতে এসে ঝাঁপ দেয়। শালুবুড়ি মন্ত্র পড়া থামায়নি এখনো। বুঝে উঠতে দেরি হয়না অমিতের যে ঐ প্রানীটি জিন ছাড়া আর কিছুই না।
গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় অমিতের।
এবার শালুবুড়ি সুরা পাঠ বন্ধ করে মাঝিকে নির্দেশ দেন নৌকা মাঝ নদীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নৌকা মাঝ নদীতে আসে। থর থর করে কাঁপছে বিপরীত দিকে বসে থাকা ছোট্ট প্রানীটি।
শালুবুড়ি তখন রক্তচক্ষু। তার পুরো শরীর থেকে যেন একটা গরম ভাপ বেরোচ্ছে অনুভব করতে পারে পাশে বসে থাকা অমিত। এবার শালুবুড়ি ঐ জিনের দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলে,
--" ছেড়ে দে ওই বাচ্চাটাকে। "
--" দেড়শো বছর অপেক্ষা করেছি মহেন্দ্রনারায়নের জন্য। এই বুড়ি, তুই আমার কিচ্ছু করতে পারবি না। সুরা জিন পড়ে আমাকে নিয়ে তো এসেছিস এখানে। কিন্তু আমি গেলে মহেন্দ্রকে আমার সাথে নিয়েই যাবো।" সাথেই ভয়ঙ্কর অট্টহাসি।
এক বার একটু মুচকি হাসি হেসে শালুবুড়ি বলে উঠলেন,
--তবে ছাড়বিনা বলছিস। আগের বার তুই প্রানে বেঁচেছিস। এখন পালাবি কোথায়। তোর পালাবার আর জায়গা নেই যে। গঙ্গার মাঝে আছিস তুই। কোনো প্রেতাত্মা, জিন, ভুত, ডাইনি, ভুলো গঙ্গা পার করার ক্ষমতা রাখে না। এক্ষুনি আমি "আয়তাল কুরছি" পাঠ করে তোকে ভস্ম করে দেবো। " কথাটা বলা মাত্রই শালুবুড়ি খুব জোরে জোরে স্পষ্ট উচ্চারণে পাঠ করতে শুরু করলেন কোরানের সব থেকে শক্তিশালী সুরা আয়তাল কুরছি।
সামনে বসে থাকা ওই জিন্নাতটি সঙ্গে সঙ্গে সুমনের রুপ ধারন করলো। তীব্র আর্তনাদের সাথে চলতে থাকলো প্রান ভিক্ষা।
তা দেখে প্রিয় বন্ধু অমিত আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। অমিত উঠতে যাবে এমন সময় কেউ যেন হাত টা শক্ত করে ধরলো তার। এ যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি। নাড়াচাড়া করার উপায় রইলো না তার।
এদিকে সুরা পাঠ চলছেই। সুমনের অবস্থা বর্ননা করা যাচ্ছে না। মুখটা অনেক বড় করে হাঁআ করে আছে সে। মুখ থেকে কিচ্ছু শব্দ বের করতে পারছে না সে।
শেষের দু লাইন পড়ার পরে শালুবুড়ি সুমনের দিকে খুব জোরে ফু দিলেন। আর ওমনি তার দেহ থেকে বেরিয়ে গেলো একটা কালো ছায়া আর গঙ্গার স্থির জলের ওপর আচমকা একটা ঢেউ বয়ে গেলো।
নৌকার ওপরেই লুটিয়ে পড়ে সুমন। শালুবুড়ির মুখ থেকে শোনা শব্দে বুকের স্পন্দন গতি ধীরে হয় অমিতের।
--" এখন সব ঠিক আছে। ওকে ছেড়ে দে আশরাফ"।
বন্ধন মুক্ত হয় অমিত। অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করলো সে।
সেদিন সকাল ছ'টায় শালুবুড়িকে বিদায় জানানোর জন্য জনা পঞ্চাশেক গ্রামের লোক জড়ো হয় নিমতিতা স্টেশনে।
--" এখন আপনাদের এই বাবুবাড়ি সম্পুর্ণভাবে নিরাপদ। প্রত্যেকদিন দরজা খুলতে পারেন। আর সরকারকে একটা চিঠি লেখে মেরামত করানোর বন্দোবস্ত করুন বাংলার এই ঐতিহ্যকে। " লক্ষীবামুনের উদ্দেশ্যই কথা গুলি বলেন শালুবুড়ি।
পাশেই সুমন ও অমিতকে দাড়িয়ে দেখে আরো বলেন -"এবার তোমারা ভালো করে ছবি তুলতে পারো এখানে।"
অমিতের চেহারায় প্রশ্নের ছাপ দেখে জিজ্ঞাসা করেন তিনি
--কিছু বলতে চাও?"
--"না মানে সবই ঠিক আছে, কিন্তু আশরাফের ব্যাপারটা বুঝলাম না। "
ফিক করে একটু হেসেই জবাবটা দিলেন তিনি
--" আশরাফ আর কেউ না। ও আমার পোষ্য জিন।।আমার দেহরক্ষী। সেদিন তোমাদের সাথেই গাড়িতে পাঠিয়ে ছিলাম আমি, যাতে তোমাদের অশুভ শক্তি কিছু করতে না পারে।"
বুকের মধ্যে একটা বরফ ঝড় উঠলো অমিতের।
(সমাপ্ত)
সৌজন্যে ©Shahnawaz Haque
Reviewed by khokan
on
10:08
Rating:
No comments: