নবদ্বীপ :- নবদ্বীপ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার একটি সুপ্রাচীন শহর ও পৌরসভা এলাকা। নবদ্বীপ পৌরসভা১৮৬৯ সালে স্থাপিত।
ইতিহাস
বাংলায় সেন রাজাদের আমলে নবদ্বীপ ছিল রাজধানী। ১২০২ সালে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময় বখতিয়ার খিলজির নবদ্বীপ জয় করেন যা বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্যের সূচনা করে। নবদ্বীপ ছিল সেই সময়ে বিদ্যালাভের পীঠস্থান ও একে বলা হত বাংলার অক্সফোর্ড।
নবদ্বীপ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্য বিখ্যাত। ভাগীরথীর পাড়ে নবদ্বীপে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে দোলপূর্ণিমায় আবির্ভাব শ্রীচৈতন্যদেবের। গঙ্গার প্রবাহ বদলে বিভ্রান্তি ঘটেছে জন্মভিটে নিয়ে। তবে শ্রীচৈতন্যের দ্বিতীয়া পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্ম আজকের নবদ্বীপে। জন্মভিটে নিয়ে বিভ্রান্তি ঘটলেও ঘরে ঘরে গৌরাঙ্গপ্রভুর মন্দির। নবদ্বীপ জুড়ে একের পর এক মন্দির আর মঠের সারি। বিরাম ণেই নাম সংকীর্তনের।
রিকশা ভাড়া করে বা পায়ে পায়ে ঘুরে নেওয়া যায় মন্দিরগুলি। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর প্রতিষ্ঠিত দারু নির্মিত মহাপ্রভুর বিগ্রহ মন্দির, বুড়ো শিব, হরিসভা, পোড়ামাতলা মহাপ্রভু মন্দির, অদ্বৈতপ্রভু মন্দির, জগাই-মাধাই, শচীমাতা-বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মভিটায় নিত্যানন্দপ্রভুর মন্দির, বড় আখাড়া, শ্রীশ্রী গোবিন্দজিউ, সোনার গৌরাঙ্গ, সমাজবাড়ি, বড় রাধেশ্যাম, রাধাবাজারে শ্রীসারস্বত গৌড়ীয় আসন, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ, মণিপুর পাড়ায় সোনার গৌরাঙ্গ, । মন্দিরের উপনিবেশ যেন নবদ্বীপ – পুরসভার হিসাবে ১৮৬টি মন্দির। হাওড়া -শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে যাওয়া যায় নবদ্বীপ। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর গিয়ে সেখান থেকে বাসে যাওয়া যায়। অথবা কৃষ্ণনগর থেকে ন্যারোগেজ লাইনে নবদ্বীপধাম স্টেশনে পৌঁছে ফেরি পেরিয়ে নবদ্বীপে যাওয়া যায় বা সরাসরি বাসে নবদ্বীপে পৌঁছনো যায়। নবদ্বীপধাম স্টেশনের কাছে মিউনিসিপাল ট্যুরিস্ট লজ। এ ছাড়া শহর জুড়ে নানান বেসরকারি লজ, ধরমশালা ও অতিথিশালা আছে। নবদ্বীপের প্রধান আকর্ষণ রাস উৎসব। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ধুমধামে পালিত হয় এই রাস মেলা। রাসে মূর্তিপূজায় বৈচিত্র্য আছে নবদ্বীপে।
রাসকালে শাক্ত মতে পূজার্চনা হয়। নানা রূপে বিশালাকার শাক্ত দেবী দুর্গা, কালী ছাড়াও অন্যান্য দেবদেবীও পূজিত হন রাসে। দোল উৎসবেরও মাধুর্য আছে নবদ্বীপে। দোলপূর্ণিমার আগের দিন সন্ধ্যায় শ্রীকৃষ্ণের মাধবাসুর বধ স্মরণে ন্যাড়াপোড়া দিয়ে পক্ষকালব্যাপী উৎসবের সুচনা। দোলের সকালে নগর পরিক্রমা। মহাপ্রভুর জন্মদিনে মহাপ্রভুর চরণ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি-সহ আলোর রোশনাই ও বাদ্যির বৈভবে বের হয় নগর সংকীর্তন। সে-ও দেখার। সব মিলিয়ে ভ্রমণ প্রিয় মানুষের পক্ষে নবদ্বীপের আকর্ষণ উপেক্ষা করা অসম্ভব।
নামকরণ
নবদ্বীপ নামের উৎস সম্বন্ধে নানা ধারনা প্রচলিত আছে। নবদ্বীপ ও নদিয়া এই দুটি নামই এই জনপদে প্রচলিত। এই শহর বহু বার বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয়েছে, যার ফলে উচ্চারণের বিকৃতির মাধ্যামে নদিয়া ও নবদ্বীপ সম্পর্কযুক্ত হতে পারত, যদিও তা হয় নি। নবদ্বীপ, 'নূদীয়া' 'নওদিয়া'বা 'নদীয়াহ' হয়েছে ভাষান্তরের জন্য। রজনীকান্ত চক্রবর্তী স্পষ্ট জানিয়েছেন, "মিনহাজউদ্দিন সিরাজির গ্রন্থে নবদ্বীপকে নওদিয়ার বলা হইয়াছে। নওদিয়ার শব্দে নূতন দেশ।" নূতন দেশ বলতে এখানে গঙ্গাবিধৌত পলিসঞ্জাত নুতন দ্বীপকেই বোঝান হয়েছে।
কবি কর্ণপুর তাঁর ‘চৈতন্য চরিতামৃতাম্’ মহা কাব্যে নবদ্বীপকে ‘নবীন দ্বীপং’ বলে উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে নুলো পঞ্চানন বলেছেন, ‘কহেন রাজা কাহার কথা অভিলাশ। নব নব দ্বীপপুঞ্জ নবদ্বীপে প্রকাশ।’ লক্ষ্মণ সেনের সমসাময়িক এডু মিশ্র নবদ্বীপ সম্বন্ধ্যে বলেছেন, ‘গঙ্গাগর্ভোস্থিত দ্বীপ দ্বীপপূঞ্জৈবর্হিধৃত। প্রতিচ্যাং যস্য দেশস্য গঙ্গাভাতি নিরন্তরম।’
নবদ্বীপ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া জায় কৃত্তিবাস ওঝার রামায়াণে। তিনি অবশ্য নদিয়া এবং নবদ্বীপ দুটি নামই উল্লেখ করেছেন-‘গঙ্গারে লইয়া জান আনন্দিত হইয়া আসিয়া মিলিল গঙ্গা তীর্থ যে নদীয়া। সপ্তদ্বীপ মধ্যে সার নবদ্বীপ গ্রাম। একঅরাত্রি গঙ্গা তথা করিল বিশ্রাম।।’ মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের মতে গঙ্গা গর্ভোত্থিত নতুন দ্বীপটি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সুসংবদ্ধ উচ্চারণে হয়ে ছিল ‘নবদ্বীপ’। পরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খলজি নবদ্বীপ জয় করার পর ফার্সি-ভাষায় নবদ্বীপ অর্থে নতুন দ্বীপ কথাটির ভাষান্তর ঘটিয়ে ‘নদিয়া’ করেছেন মাত্র। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নরহরি চক্রবর্তী (ঘনশ্যাম দাস) প্রচার করলেন নবদ্বীপ হচ্ছে নয়টি দ্বীপের সমষ্টি। তিনি বলেন- ‘দ্বীপ নাম শ্রাবণে সকল দুঃখ ক্ষয়। গঙ্গা পূর্ব-পশ্চিম তিরেতে দ্বীপ নয়। পুরবে অন্তদ্বীপ, শ্রীসীমন্তদ্বীপ হয়। গোদ্রুমদ্বীপ, শ্রীমধ্যদ্বীপ চতুষ্টয়। কোলদ্বীপ, ঋতু, জহ্নু, মোদদ্রুম আর। রুদ্রদ্বীপ এই পঞ্চ পশ্চিমে প্রচার।।’ নরহরি চক্রবর্তীর পূর্বে রচিত বিশাল বৈষ্ণব-সাহিত্যের কথাও নবদ্বীপকে নয়টি দ্বীপের সমষ্টি বলা হয়নি। তিনিই প্রথম নয়টি স্থানকে দ্বীপ হিসাবে চিহ্নিত করে প্রচার করেন।
নদিয়ার নামকরণ প্রসঙ্গে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী একটি কিংবদন্তির উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, ভাগীরথী তীরস্থ নবসৃস্ট চরভূমিতে এক তান্ত্রিক প্রতিদিন সন্ধ্যায় ন’টি দিয়া (প্রদীপ) জ্বালিয়ে তন্ত্র-সাধানা করতেন। দূর থেকে দেখে লোকে এই দ্বীপটিকে ন’দিয়ার চর বলত। আর সেই থেকেই নাকি লোকমুখে ‘নদিয়া’ নামের প্রচলন করে।
জনসংখ্যা
ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারিঅনুসারে নবদ্বীপ শহরের জনসংখ্যা হল ১,৭৫,৪৭৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫১.৭৫%, এবং নারী ৪৮.২৫%। এই শহরের জনসংখ্যার ৭.৪৪% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী। সাক্ষরতার হার ৮৭.৫৭%, ।
শিক্ষা
২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে নবদ্বীপ শহরের জনসংখ্যা ছিল ১,১৫,০৩৬ জন। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮০%, এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭০%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে নবদ্বীপের সাক্ষরতার হার বেশি।
নবদ্বীপে মোট ১৮টি উচ্চ বিদ্যালয় আছে; এদের মধ্যে নবদ্বীপ বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়, নবদ্বীপ হিন্দু স্কুল, নবদ্বীপ শিক্ষা মন্দির, আর. সি. বি. সারস্বত মন্দির, জাতীয় বিদ্যালয়, তারাসুন্দরী বালিকা (উচ্চ) বিদ্যালয়, নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য। এখানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয় নামে একটি মহাবিদ্যালয়ও আছে।
উৎসব
এখানকার উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ নববর্ষ, চন্দনযাত্রা, গাজন উৎসব, রথযাত্রা, ঝুলন পূর্ণিমা, গঙ্গা পূজা, দুর্গা পূজা, রাস যাত্রা, দোল পূর্ণিমা, সরস্বতী পূজা, গুরু পূর্ণিমা, ধুলোট, গৌর-পূর্ণিমাপ্রভৃতি। এদের মধ্যে রাস এবং দোলযাত্রা মহাসমারহে পালিত হয়।
source :- History and Facts
Reviewed by Dhuliyan City
on
03:54
Rating:
No comments: