আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ তরখড় ছিলেন সমাজ সংস্কারক‚ প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা | জনার্দন পান্ডুরঙ্গ ছিলেন সূত্রধর‚ সহজ করে বললে ছুতোর | ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রে ছিল স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সংসার | সামাজিক ব্যবধান থাকলেও প্রার্থনা সমাজের আলোকিত স্পর্শ পেয়েছিল তাঁর পরিবারও |
উজ্জ্বল আলোকের মধ্যেই আচমকা কালো ছায়া | মারা গেলেন জনার্দন | তরুণী স্ত্রী এবং আট বছরের মেয়েকে অসহায় করে | ঘোর এই দুঃসময়ে শক্ত হাতে হাল ধরলেন জনাদর্নের স্ত্রী জয়ন্তীবাঈ | প্রথমেই সব সম্পত্তি একমাত্র মেয়ে রুখমার নামে করলেন | তিন বছর পরে রুখমার বিয়ে দিয়ে দিলেন | ১৮৬৪ সালের ২২ নভেম্বর জন্মানো রুখমার বিয়ে হয়ে গেল ১৮৭৫ সালে | পাত্র উনিশ বছর বয়সী দাদাজি ভিকাজি | মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিজেও দ্বিতীয় বিয়ে করলেন জয়ন্তী | বিপত্নীক ডক্টর সখারাম অর্জুনকে | সখারাম নিজেও ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক | আত্মারাম পান্ডুরঙ্গের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি |
কিন্তু মা এবং সৎ বাবার সংসারে রয়ে গেলেন রুখমাও | স্বামীর ঘর করবেন কী ! রুখমার স্বামী দাদাজি মাতৃহীন | মানুষ মামাবাড়িতে | সেখানে পরিবেশের দোষে তিনি নিজেও উচ্ছৃঙ্খল | তাঁর মামা থাকেন রক্ষিতা নিয়ে | রাগে দুঃখে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন মামী | এই পরিবেশে কিছুতেই গেলেন না রুখমা | মাত্র ১১ বছর বয়সেই প্রখর তাঁর বাস্তববুদ্ধি | পূর্ণ সমর্থন পেলেন সৎ বাবা সখারামের | স্ত্রী জয়ন্তী কিন্তু কিন্তু করলেও সখারাম এককথায় নাকচ করে দিলেন | বলে দিলেন‚ রুখমা থাকবেন তাঁদের সঙ্গেই | শুধু থাকাই নয় | তাঁকে পড়াশোনা করতে হবে | স্থানীয় গির্জার ফ্রি লাইব্রেরি থেকে বই আনানোর ব্যবস্থা করলেন | বাড়িতেই চলল রুখমার লেখাপড়া |
এরপর বছর নয়েক কিছুটা স্বস্তি | তারপর শুরু নতুন বিড়ম্বনা | রীতিমতো উকিলের চিঠি পাঠালেন দাদাজি | তাঁর স্ত্রীকে পাঠাতে হবে তাঁর কাছে | সখারাম প্রথমে ভাবলেন আদালতের বাইরেই মিটে যাবে | কিন্তু হল না | যেতেই হল আইনের পথে | কুড়ি বছরের রুখমার চোখ থেকে তখন বিয়ে-সংসারের স্বপ্ন মুছে গেছে | তিনি বিভোর নিজের বইয়ের জগতে | স্পষ্ট বলে দিলেন‚ স্বামীর কাছে যাবেন না | সবথেকে বড় কথা‚ বালিকা বয়সে বিয়ে হওয়া ওই ব্যক্তিকে তিনি স্বামী বলে মানতেই নারাজ |
এরপর যে দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হল‚ তা ভারতীয় আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে বিখ্যাত | দাদাজির পক্ষে উকিল ছিল চক অ্যান্ড ওয়াকার | সখারাম নিয়োগ করলেন পেন এবং গিলবার্টকে | দুঁদে ব্রিটিশ আইনজীবীদের মধ্যে জমে উঠল লড়াই | দাদাজির আইনজীবীরা আদালতে সওয়াল করলেন‚ জনার্দনের সম্পত্তি ভোগ করতেই স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাইছেন না সখারাম |
দীর্ঘ সওয়াল-জবাব-শুনানির পরে রায় দিলেন বিচারক রবার্ট হিল পিনহে | বললেন‚ রুখমাবাঈয়ের বিয়ে হয়েছিল শৈশবে‚ তাঁর অমতে | এখন তিনি সাবালক | স্বামীর ঘর করতে চাইতে নাও পারেন | তাই তাঁর অসম্মতিতে তাঁকে স্বামীগৃহে পাঠানো বেআইনি | এই রায়দানের পরে অবসর নেন পিনহে |
তৎকালীন ভারতীয় সমাজে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল এই রায় | সংবাদমাধ্যম দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল | সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং জনমতের বেশির ভাগই গিয়েছিল দাদাজির পক্ষে | তাদের মত ছিল‚ ব্রিটিশ আইনব্যবস্থা ভারতীয় বিবাহরীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না | ভারতীয় বিয়েতে পাত্র পাত্রীর সম্মতিকে এত গুরুত্ব দিলে হবে না |
প্রথম সারির সব সংবাদপত্রে তখন তুলোধনা করা হচ্ছে পিনহের রায়কে | পাবলিক সেন্টিমেট বইছে স্ত্রীসঙ্গ বর্জিত দাদাজির প্রতি | এমনকী‚ বাল গঙ্গাধর তিলকও বললেন‚ ভারতীয় বিয়েতে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যই মানতে হবে | এই সময়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় শুরু হল নতুন কলাম | ‘ এ হিন্দু লেডি‘ ছদ্মনামে | সেই লেখায় বলিষ্ঠভাবে যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়‚ কেন এবং কীভাবে একজন হিন্দু নারী হিসেবেই রুখমাবাঈয়ের অধিকার আছে স্বামীগৃহে না যাওয়ার | পরে জানা যায় লেখক ছিলেন স্বয়ং রুখমা বাঈ |
১৮৮৭ সালে আবার শুরু হল এই মামলার শুনানি | এ বার রায় গেল রুখমা বাঈয়ের বিরুদ্ধে | বিচারক ফ্যারান নির্দেশ দিলেন‚ স্বামী দাদাজির কাছে যেতে হবে স্ত্রী রুখমাবাঈকে | নতুবা ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে | উত্তরে রুখমা জানালেন তিনি স্বামীগৃহের বদলে কারাগারে যেতে চান ! তাঁর এই পদক্ষেপে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা সমাজ |
বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর কেশরী পত্রিকায় বলেন‚ রুখমার এই আচরণ ইংরেজি বা পাশ্চাত্য শিক্ষার কুফল | কিন্তু ভারত গবেষক এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ম্যাক্সমুলার বললেন‚ রুখমার শিক্ষাই তাঁকে বলছে মনের কথা শুনতে | এবং এই ঘটনার নিষ্পত্তি করতে আইন করতে অপারগ |
রুখমা এ বার সরাসরি চিঠি লিখলেন রানি ভিক্টোরিয়াকে | তাঁর বিয়ে বাতিল করতে হবে | হাজারো কোর্ট কাছারি যা করতে পারেনি‚ তাই হল ইংল্যান্ডেশ্বরীর কলমের এক খোঁচায় | বিবাহ নামক সম্পর্কের বোঝা থেকে মুক্তি পেলেন রুখমাবাঈ | ১৮৮৮ সালে হলফনামা গেল দাদাজির কাছে | রুখমাবাঈয়ের উপর তাঁর আর কোনও অধিকার রইল না | তাঁদের তেরো বছরের বিয়ে ( শুধু নামেই) তখন থেকে অতীত হল |
সব পিছুটানমুক্ত হয়ে রুখমাবাঈ চলে গেলেন ইংল্যান্ডে | ১৮৮৯ সালে ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অফ মেডিসিন ফর উইমেন-এ | ইংল্যান্ড থেকে প্রভূত সাহায্য পেয়েছিলেন | স্বদেশ থেকে বিশেষ সহায়তা না পেলেও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ইন্দোরের মহারাজা শিবাজিরাও হোলকর | এই সাহসিনীকে সাহায্য করেছিলেন নগদ ৫০০ টাকা দিয়ে | তখনকার দিনে এর মূল্য নেহাত কম নয় |
রুখমা যে বছর ইংল্যান্ড গেলেন তার তিন বছর আগেই ডাক্তারির ডিগ্রি পেয়ে গেছেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি এবং আনন্দী গোপাল যোশি | ব্রিটিশ উপনিবেশে কাদম্বিনী ছিলেন প্রথম প্র্যক্টিসিং লেডি ডক্টর | অকালমৃত্যু আনন্দী গোপালকে প্র্যাক্টিস করতে দেয়নি | তাঁদের পরেই ব্রিটিশ ভারতে তৃতীয় মহিলা চিকিৎসক ছিলেন রুখমাবাঈ |
বিবাহ বিচ্ছেদের পর সম্পূর্ণ সাদা শাড়ি পরতেন রুখমাবাঈ | ১৯১৮ সালে দেশে ফিরে যোগ দিয়েছিলেন রাজকোট স্টেট হাসপাতালে | প্রায় ৫০ বছর গুজরাত এবং সুরাতে ডাক্তারি প্র্যাক্টিস করেছেন তিনি | প্রয়াত হন ১৯৫৫ সালে‚ ৯০ বছর বয়সে |
প্রায় ১৪২ বছর আগে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের বোঝার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এই ছক ভাঙা নারী আজ আধুনিক ভারতে বিস্মৃত | ১৫৩ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করে ডুডল বানিয়েছে গুগল | কিন্তু আমরা ভুলে গেছি | মনে রাখতে আমাদের বয়েই গেছে |
Reviewed by Dhuliyan City
on
00:47
Rating:
No comments: