১২৯ বছর আগে রানি ভিক্টোরিয়াকে চিঠি লিখে বিয়ে ভেঙেছিলেন তরুণী…পরাধীন ভারতের এই ডাক্তার আজ বিস্মৃত

আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ তরখড় ছিলেন সমাজ সংস্কারক‚ প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা | জনার্দন পান্ডুরঙ্গ ছিলেন সূত্রধর‚ সহজ করে বললে ছুতোর | ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রে ছিল স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সংসার | সামাজিক ব্যবধান থাকলেও প্রার্থনা সমাজের আলোকিত স্পর্শ পেয়েছিল তাঁর পরিবারও |

উজ্জ্বল আলোকের মধ্যেই আচমকা কালো ছায়া | মারা গেলেন জনার্দন | তরুণী স্ত্রী এবং আট বছরের মেয়েকে অসহায় করে | ঘোর এই দুঃসময়ে শক্ত হাতে হাল ধরলেন জনাদর্নের স্ত্রী জয়ন্তীবাঈ | প্রথমেই সব সম্পত্তি একমাত্র মেয়ে রুখমার নামে করলেন | তিন বছর পরে রুখমার বিয়ে দিয়ে দিলেন | ১৮৬৪ সালের ২২ নভেম্বর জন্মানো রুখমার বিয়ে হয়ে গেল ১৮৭৫ সালে | পাত্র উনিশ বছর বয়সী দাদাজি ভিকাজি | মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিজেও দ্বিতীয় বিয়ে করলেন জয়ন্তী | বিপত্নীক ডক্টর সখারাম অর্জুনকে | সখারাম নিজেও ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক | আত্মারাম পান্ডুরঙ্গের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি | 

কিন্তু মা এবং সৎ বাবার সংসারে রয়ে গেলেন রুখমাও | স্বামীর ঘর করবেন কী ! রুখমার স্বামী দাদাজি মাতৃহীন | মানুষ মামাবাড়িতে | সেখানে পরিবেশের দোষে তিনি নিজেও উচ্ছৃঙ্খল | তাঁর মামা থাকেন রক্ষিতা নিয়ে | রাগে দুঃখে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন মামী | এই পরিবেশে কিছুতেই গেলেন না রুখমা | মাত্র ১১ বছর বয়সেই প্রখর তাঁর বাস্তববুদ্ধি | পূর্ণ সমর্থন পেলেন সৎ বাবা সখারামের | স্ত্রী জয়ন্তী কিন্তু কিন্তু করলেও সখারাম এককথায় নাকচ করে দিলেন | বলে দিলেন‚ রুখমা থাকবেন তাঁদের সঙ্গেই | শুধু থাকাই নয় | তাঁকে পড়াশোনা করতে হবে | স্থানীয় গির্জার ফ্রি লাইব্রেরি থেকে বই আনানোর ব্যবস্থা করলেন | বাড়িতেই চলল রুখমার লেখাপড়া | 

এরপর বছর নয়েক কিছুটা স্বস্তি | তারপর শুরু নতুন বিড়ম্বনা | রীতিমতো উকিলের চিঠি পাঠালেন দাদাজি | তাঁর স্ত্রীকে পাঠাতে হবে তাঁর কাছে | সখারাম প্রথমে ভাবলেন আদালতের বাইরেই মিটে যাবে | কিন্তু হল না | যেতেই হল আইনের পথে | কুড়ি বছরের রুখমার চোখ থেকে তখন বিয়ে-সংসারের স্বপ্ন মুছে গেছে | তিনি বিভোর নিজের বইয়ের জগতে | স্পষ্ট বলে দিলেন‚ স্বামীর কাছে যাবেন না | সবথেকে বড় কথা‚ বালিকা বয়সে বিয়ে হওয়া ওই ব্যক্তিকে তিনি স্বামী বলে মানতেই নারাজ | 

এরপর যে দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হল‚ তা ভারতীয় আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে বিখ্যাত | দাদাজির পক্ষে উকিল ছিল চক অ্যান্ড ওয়াকার | সখারাম নিয়োগ করলেন পেন এবং গিলবার্টকে | দুঁদে ব্রিটিশ আইনজীবীদের মধ্যে জমে উঠল লড়াই | দাদাজির আইনজীবীরা আদালতে সওয়াল করলেন‚ জনার্দনের সম্পত্তি ভোগ করতেই স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাইছেন না সখারাম | 

দীর্ঘ সওয়াল-জবাব-শুনানির পরে রায় দিলেন বিচারক রবার্ট হিল পিনহে | বললেন‚ রুখমাবাঈয়ের বিয়ে হয়েছিল শৈশবে‚ তাঁর অমতে | এখন তিনি সাবালক | স্বামীর ঘর করতে চাইতে নাও পারেন | তাই তাঁর অসম্মতিতে তাঁকে স্বামীগৃহে পাঠানো বেআইনি | এই রায়দানের পরে অবসর নেন পিনহে | 

তৎকালীন ভারতীয় সমাজে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল এই রায় | সংবাদমাধ্যম দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল | সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং জনমতের বেশির ভাগই গিয়েছিল দাদাজির পক্ষে | তাদের মত ছিল‚ ব্রিটিশ আইনব্যবস্থা ভারতীয় বিবাহরীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না | ভারতীয় বিয়েতে পাত্র পাত্রীর সম্মতিকে এত গুরুত্ব দিলে হবে না | 

প্রথম সারির সব সংবাদপত্রে তখন তুলোধনা করা হচ্ছে পিনহের রায়কে | পাবলিক সেন্টিমেট বইছে স্ত্রীসঙ্গ বর্জিত দাদাজির প্রতি | এমনকী‚ বাল গঙ্গাধর তিলকও বললেন‚ ভারতীয় বিয়েতে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যই মানতে হবে | এই সময়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় শুরু হল নতুন কলাম | ‘ এ হিন্দু লেডি‘ ছদ্মনামে | সেই লেখায় বলিষ্ঠভাবে যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়‚ কেন এবং কীভাবে একজন হিন্দু নারী হিসেবেই রুখমাবাঈয়ের অধিকার আছে স্বামীগৃহে না যাওয়ার | পরে জানা যায় লেখক ছিলেন স্বয়ং রুখমা বাঈ |

১৮৮৭ সালে আবার শুরু হল এই মামলার শুনানি | এ বার রায় গেল রুখমা বাঈয়ের বিরুদ্ধে | বিচারক ফ্যারান নির্দেশ দিলেন‚ স্বামী দাদাজির কাছে যেতে হবে স্ত্রী রুখমাবাঈকে | নতুবা ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে | উত্তরে রুখমা জানালেন তিনি স্বামীগৃহের বদলে কারাগারে যেতে চান ! তাঁর এই পদক্ষেপে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা সমাজ |

বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর কেশরী পত্রিকায় বলেন‚ রুখমার এই আচরণ ইংরেজি বা পাশ্চাত্য শিক্ষার কুফল | কিন্তু ভারত গবেষক এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ম্যাক্সমুলার বললেন‚ রুখমার শিক্ষাই তাঁকে বলছে মনের কথা শুনতে | এবং এই ঘটনার নিষ্পত্তি করতে আইন করতে অপারগ |

রুখমা এ বার সরাসরি চিঠি লিখলেন রানি ভিক্টোরিয়াকে | তাঁর বিয়ে বাতিল করতে হবে | হাজারো কোর্ট কাছারি যা করতে পারেনি‚ তাই হল ইংল্যান্ডেশ্বরীর কলমের এক খোঁচায় | বিবাহ নামক সম্পর্কের বোঝা থেকে মুক্তি পেলেন রুখমাবাঈ | ১৮৮৮ সালে হলফনামা গেল দাদাজির কাছে | রুখমাবাঈয়ের উপর তাঁর আর কোনও অধিকার রইল না | তাঁদের তেরো বছরের বিয়ে ( শুধু নামেই) তখন থেকে অতীত হল |

সব পিছুটানমুক্ত হয়ে রুখমাবাঈ চলে গেলেন ইংল্যান্ডে | ১৮৮৯ সালে ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অফ মেডিসিন ফর উইমেন-এ | ইংল্যান্ড থেকে প্রভূত সাহায্য পেয়েছিলেন | স্বদেশ থেকে বিশেষ সহায়তা না পেলেও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ইন্দোরের মহারাজা শিবাজিরাও হোলকর | এই সাহসিনীকে সাহায্য করেছিলেন নগদ ৫০০ টাকা দিয়ে | তখনকার দিনে এর মূল্য নেহাত কম নয় |

রুখমা যে বছর ইংল্যান্ড গেলেন তার তিন বছর আগেই ডাক্তারির ডিগ্রি পেয়ে গেছেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি এবং আনন্দী গোপাল যোশি | ব্রিটিশ উপনিবেশে কাদম্বিনী ছিলেন প্রথম প্র্যক্টিসিং লেডি ডক্টর | অকালমৃত্যু আনন্দী গোপালকে প্র্যাক্টিস করতে দেয়নি | তাঁদের পরেই ব্রিটিশ ভারতে তৃতীয় মহিলা চিকিৎসক ছিলেন রুখমাবাঈ | 

বিবাহ বিচ্ছেদের পর সম্পূর্ণ সাদা শাড়ি পরতেন রুখমাবাঈ | ১৯১৮ সালে দেশে ফিরে যোগ দিয়েছিলেন রাজকোট স্টেট হাসপাতালে | প্রায় ৫০ বছর গুজরাত এবং সুরাতে ডাক্তারি প্র্যাক্টিস করেছেন তিনি | প্রয়াত হন ১৯৫৫ সালে‚ ৯০ বছর বয়সে | 

প্রায় ১৪২ বছর আগে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের বোঝার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এই ছক ভাঙা নারী আজ আধুনিক ভারতে বিস্মৃত | ১৫৩ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করে ডুডল বানিয়েছে গুগল | কিন্তু আমরা ভুলে গেছি | মনে রাখতে আমাদের বয়েই গেছে |

১২৯ বছর আগে রানি ভিক্টোরিয়াকে চিঠি লিখে বিয়ে ভেঙেছিলেন তরুণী…পরাধীন ভারতের এই ডাক্তার আজ বিস্মৃত 
১২৯ বছর আগে রানি ভিক্টোরিয়াকে চিঠি লিখে বিয়ে ভেঙেছিলেন তরুণী…পরাধীন ভারতের এই ডাক্তার আজ বিস্মৃত Reviewed by Dhuliyan City on 00:47 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.