ধ্বংসের প্রহর গুনছে নিমতিতা রাজবাড়ি ।

নিমতিতা রাজবাড়ি
 
কঙ্কালসার জীর্ণদশা নিয়ে গঙ্গানদীর দিকে মুখ করে ধ্বংসের প্রহর গুনছে নিমতিতা রাজবাড়ি

মুর্শিদাবাদ জেলার সামশেরগঞ্জ ব্লকের  নিমতিতা রাজবাড়ি বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে এক সময় বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। সুদূর কলকাতা থেকে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর 'জলসাঘর' (১৯৫৭), 'দেবী' (১৯৫৯), 'সমাপ্তি' (১৯৬০) সিনেমার শুটিং করতে এই রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির চাকচিক্য ও জাঁকজমক মন কেড়ে নিয়েছিল সিনেমাপ্রেমী মানুষের সেই সময়।

তখন গঙ্গা ছিল জমিদারবাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাড়ির পাশেই একটা মস্ত পুকুর। ট্রলি পাতা হয়েছে সেখানে। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন ছবি বিশ্বাস। নিজেই চাপলেন ঘোড়ার পিঠে। পরক্ষণেই নেমেও পড়লেন। এ বার ছবি বিশ্বাসের পোশাক পরানো হল সহিসকে। ঘোড়ায় ছুটলেন সহিস। বেশ খানিকটা দূরে নদীর পাড়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন সহিস। আবার ছবি বিশ্বাস পড়ে নিলেন সেই পোশাক। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ছবি বিশ্বাস। জলসাঘর সিনেমার স্যুটিং দেখার সেই স্মৃতি এখনও ভোলেননি এলাকার মানুষ।
উঠোনভরা লোকলস্কর, ঠাকুর-চাকর, দরজায় সান্ত্রী। নিমতিতা রাজবাড়ির সেই গমগমে অবস্থাটা এখনও যেন চোখের সামনে দেখতে পান সত্তরোর্ধ্ব শিশির দাস।

গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী দুই ভাই মিলে এই বাড়িতে জমিদারী কাজ শুরু করেন ১৮৫৫ সালে। ইতালিয়ান ধাঁচে পাঁচটি উঠোন এবং দেড়শো কক্ষ বিশিষ্ট এই রাজবাড়িটি নির্মিত। তখন এই বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত মানুষের আগমন ঘটেছে। দ্বারকানাথের ছেলে জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণের বিয়ের সময় কলকাতার স্টার থিয়েটার গ্রুপকে নাট্য অভিনয় করার জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। বিখ্যাত অভিনেতা ক্ষিরোদপ্রাসাদ বিদ্যা বিনয় তাঁর নাট্যগোষ্ঠী নিয়ে নিমতিতার রাজবাড়িতে এলে দ্বারকানারায়ণের পুত্র মহেন্দ্র নারায়ণ রাজবাড়িতে নিমতিতা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতি বছর হোলির সময় নাটক মঞ্চস্থ হোত। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির ভাদুরী এই রাজবাড়ির মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে মহেন্দ্রনারায়ণের প্রচেষ্টায় নিমতিতা খ্যাতি অর্জন করেছিল সেইসময়। সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। গঙ্গা খেয়েছে সব। ১৯৪৪-এর বন্যার সময়, ভেঙে পড়ে রঙ্গমঞ্চটি। ভাঙনের সেই শুরুর দশক শতক পেরিয়ে, আজ হারাতে বসেছে রাজবাড়িই। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির  ভাদুরী এই রাজবাড়ির মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে মহেন্দ্রনারায়ণের প্রচেষ্টায় নিমতিতা  খ্যাতি অর্জন করেছিল সেই সময়।

এছাড়াও রাজবাড়িতে পদার্পণ ঘটেছিল (কালাজ্বরের ঔষুধ আবিষ্কারক) বাঙালি বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, মুর্শিদাবাদ জেলার তৎকালিন জেলাশাসক তথা শিশু সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, সাহিত্যিক লীলা মজুমদার, কবি কাজি নজরুল ইসলাম, দাদাঠাকুর প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিদের। আবার সত্যজিৎ রায় ১৯৫৭ ‘জলসাঘর’ ছবির শ্যুট করেছিলেন এই নিমতিতা রাজবাড়িতেই। শুধু ‘জলসাঘর’ই নয়, ১৯৫৯‘দেবী’ এবং ১৯৬০ সালে ‘সমাপ্তি’। সত্যজিতের রায়ের এই তিনটি সিনেমার ফ্রেমে ফ্রেমে বেঁচে রয়েছে নিমতিতা রাজবাড়ির জৌলুস। আজও এই রাজ বাড়ির পাশে দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথীর, গঙ্গা নদী। ভাদ্র মাসে বন্যার সময়ে জল উঁকি দিয়ে যায় রাজবাড়ির উঠোনে। তাছাড়া এই রাজ বাড়ির চার পাশে রয়েছে মনোরম দৃশ্যও। তবে ইতিমধ্যেই হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা চলছে পুরোদমে। স্বীকৃতি এলে পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠবে এই ঐতিহ্যের রাজবাড়ি। প্রত্যয়ী এই এলাকাবাসি। চাইলে সংস্কারের মাধ্যমে একটি ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতেই পারে রাজবাড়িটিকে। এখন এই ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি তার মাথার উপরের ছাদ ভেঙে যাওয়ায় আকাশ উকি দিচ্ছে ঘরে। কড়িকাঠের বর্গাগুলো দখল নিয়েছে ঘুণপোকায়। দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে চুনসুরকি বালি। লতা ও আগাছা বংশ বিস্তার শুরু করে দিয়েছে ইটের ফাকে ফাকে। বৃষ্টির জল ও সূর্যের রোদ সঙ্গ দিয়েছে রাজবাড়ির দেওয়াল ও মেঝেতে। পিঁপড়ে ও কীটপতঙ্গ বাসা বেঁধেছে দেওয়ালের ফাঁকে। বর্তমানে কঙ্কালসার জীর্ণদশা নিয়ে গঙ্গানদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের প্রহর গুনছে রাজবাড়িটি।

শেষ রানিমা সবিতা চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন বছর ছয়েক আগে। এক মাত্র পরিচারক গোবর্ধন দাসও মারা গিয়েছেন। সবিতাদেবীর দুই ছেলে বর্তমানে থাকেন কলকাতায়। আজ সেই রাজবাড়ি নয়নমুদ্ধ আভিজাত্যের জৌলুস হারিয়ে শুধু কঙ্কালসার জীর্ণদশা নিয়ে গঙ্গানদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে ধ্বংসের। মাথার উপরের ছাদ ভেঙে আকাশ উঁকি দিচ্ছে ঘরে। কড়িকাঠের বর্গাগুলো দখল নিয়েছে ঘুণপোকা। দেওয়া থেকে খসে পড়েছে চুনসুরকি বালি। লতা ও আগাছা বংশ বিস্তার শুরু করে দিয়েছে ইঁটের ফাঁকে ফাঁকে। বৃষ্টির জল ও সূর্যের রোদ সঙ্গ দিয়েছে রাজবাড়ির দেওয়াল ও মেঝের যত্রতত্র। পিঁপড়ে ও কীটপতঙ্গ বাসা বেঁধেছে দেওয়ালের ফাঁকে। রাজবাড়ির অন্তিম লগ্নটা যেন 'জলসাঘর' সিনেমার  বিশ্বম্ভর রায়ের জমিদারিত্ব ভেঙে , সিনেমায়  মুছে গিয়েছিল জমিদারের চাকচিক্য। এই রাজবাড়ির পরিণতিও যেন সত্যজিৎবাবুর 'জলসাঘর' সিনেমার শেষ দৃশ্যের ভবিষ্যৎ বাণী।


সংগৃহিত

নিমতিতা রাজবাড়ি
ধ্বংসের প্রহর গুনছে নিমতিতা রাজবাড়ি । ধ্বংসের প্রহর গুনছে নিমতিতা রাজবাড়ি । Reviewed by Dhuliyan City on 10:10 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.