কুষ্ঠ রোগ কি? রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করনীয়

ইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রি ব্যাক্টেরিয়াটি খুব ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং এদের দ্বিগুণ হতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। কুষ্ঠ রোগ সাধারনত ত্বক, চোখ, নাকের মিউকাস মেমব্রেন, মস্তিষ্ক, মেরুদন্ডের বাইরের দিকের স্নায়ু এবং অন্ডকোষের ক্ষতি করে।

কিভাবে কুষ্ঠ রোগ ছড়ায় ::-

নিঃশ্বাসের সাথে এ রোগ ছড়াতে পারে।
আক্রান্ত ব্যক্তির নাক-মুখ দিয়ে ঝরা সর্দির মাধ্যমে।
কুষ্ঠ রোগীর স্পর্শের মাধ্যমে কুষ্ঠ রোগ ছড়াতে পারে। তবে সাধারনত স্পর্শের মাধ্যমে এটি ছড়ায় না।
আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ এবং দীর্ঘ সময় ধরে মেলামেশার ফলে কুষ্ঠ রোগ হতে পারে। অল্প বা সামান্য মেলামেশায় সাধারনত এ রোগ ছড়ায় না।
অনেক ক্ষেত্রে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলেও কুষ্ঠরোগ হয় না।
জীনগত কারন অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণের জন্য দায়ী হতে পারে। এ সমস্ত রোগীর ক্ষেত্রে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলে তাদের কুষ্ঠ রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

কাদের হতে পারে ::-

যে কোন বয়সেই কুষ্ঠ রোগ হতে পারে। তবে সাধারনভাবে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী অথবা ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা যায়।

প্রকারভেদ ::-

উপসর্গের উপর ভিত্তি করে কুষ্ঠ রোগ সাধারনত তিন রকম হতে পারে। যেমন- টিউবারকিউলয়েড(Tuberculoid) কুষ্ঠ, লেপ্রোমেটাস (Lepromatous) কুষ্ঠ এবং বর্ডারলাইন (Borderline) কুষ্ঠ। আবার, আক্রান্ত অবস্থার উপর নির্ভর করে কুষ্ঠ রোগ সাধারনত দুই রকম হতে পারে। যেমন- পসিব্যাসিলারী (Paucibacillary) এবং মাল্টিব্যাসিলারী (Multibaicllary)। ত্বকের পাঁচ বা পাঁচের কম জায়গা আক্রান্ত হলে সেটা পসিব্যাসিলারী। অপরদিকে ছয় বা ছয়ের বেশি জায়গা আক্রান্ত হলে সেটা মাল্টিব্যাসিলারী।

কুষ্ঠ রোগের ফলে সৃষ্ট জটিলতাসমূহ ::-

কুষ্ঠ রোগের ফলে নানারকম জটিলতা হতে পারে। যেমন- কিডনির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, পায়ের তালুতে ক্ষত সৃষ্টি হলে, হাঁটতে সমস্যা হতে পারে, নাকে ক্ষত সৃষ্টি হলে নাকে বেশ কিছু সমস্যা হতে পারে (যেমন- নাক ক্ষয়ে যাওয়া, নাক থেকে রক্ত পড়া ইত্যাদি), চোখে হলে গ্লুকোমা বা অন্ধত্ব হতে পারে, পুরুষদের লেপ্রোমেটাস কুষ্ঠ হলে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে এমনকি সন্তান জন্মদানের খেত্রেও সমস্যা হতে পারে।

কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ ::-

কুষ্ঠ সংক্রমণের ৫ থেকে ৭ বছর পর সাধারনত কুষ্ঠ রোগের উপসর্গসমূহ দেখা দিতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে উপসর্গগুলো বাড়তে থাকে।

কুষ্ঠ রোগ হলে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ দেখা যায়ঃ-

ত্বকে লালচে দাগ অথবা মসৃণ সাদাটে দাগ দেখা যায়।
ত্বকের যেসব স্থান সংক্রমিত হয় সেসব জায়গায় পিন্ড দেখা যায় বা ফুলে যায়।
স্পর্শ, ব্যথা এবং তাপমাত্রার অনুভূতি হ্রাস পায়।
নিজের (যাদের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে) অজান্তেই কোন ক্ষতি করতে পারে যেমন- শরীরের কোন জায়গা আগুনে পুড়ে যাওয়া, কাটা ইত্যাদি। আবার অনেক ক্ষেত্রে, হাত বা পায়ের আঙ্গুল হারাতে পারে।
টিউবারকিউলয়েড কুষ্ঠের ক্ষেত্রে, ত্বকে লালচে দাগের সাথে কিছু কিছু জায়গায় মসৃণ সাদাটে দাগ হতে পারে এবং আক্রান্ত স্থান অসাড় হয়ে যায়।
লেপরোমেটাস কুষ্ঠের ক্ষেত্রে, ত্বকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক পিন্ড হতে পারে কিংবা অনেকখানি স্থান জুড়ে নানান আকারের লালচে দাগ হতে পারে, মাংসপেশী দূর্বল হয়ে পড়ে এবং শরীরের বেশিরভাগ স্থান অসাড় হয়ে যায়। এ রোগে শরীরের বেশিরভাগ অঙ্গ এবং ত্বকের বেশির ভাগ অংশ আক্রান্ত হতে পারে।
বর্ডারলাইন কুষ্ঠের ক্ষেত্রে, টিউবারকিউলয়েড কুষ্ঠ এবং লেপরোমেটাস কুষ্ঠের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এটা টিউবারকিউলয়েড কুষ্ঠের মত বৈশিষ্ট্য দেখায় এবং পরবর্তীতে অবস্থা খারাপ হলে লেপ্রোমেটাস কুষ্ঠের বৈশিষ্ট্য দেখায়।

রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ::-

সাধারনত কুষ্ঠ রোগের উপসর্গ দেখেই বোঝা যায় যে কুষ্ঠ হয়েছে। তারপরেও রোগ নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আক্রান্ত স্থানের ত্বকের টিস্যু পরীক্ষা এবং রক্তের পরীক্ষা করতে হতে পারে।

কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধে করনীয় ::-

আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে নিঃসৃত তরল জাতীয় পদার্থ যেমন- নাক-মুখ দিয়ে ঝরা সর্দির মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। এসবের সংস্পর্শে আসা যাবে না।
যদিও সাধারনত স্পর্শের মাধ্যমে এটি ছড়ায় না তারপরেও কুষ্ঠ রোগীর স্পর্শের ব্যপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে এবং দীর্ঘ সময় ধরে মেলামেশায় কুষ্ঠের সংক্রমন হতে পারে। তাই, আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার ব্যপারে সাবধান হতে হবে।
পরিবারে কেউ এ রোগে আক্রান্ত থাকলে জীবাণুর সংক্রমনে কুষ্ঠ রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে, জীবাণু সংক্রমনের ব্যপারে অধিক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আক্রান্ত রোগীর ত্বকের ফুসকুড়ি এবং ফুসকুড়ি থেকে নিঃসরিত পদার্থের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে।
বিসিজি টিকা গ্রহনের মাধ্যমে কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
কুষ্ঠ রোগ কি? রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করনীয়

চিকিৎসা ::-

কুষ্ঠ রোগের সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হলেও এটা অধিক সংক্রমক নয়। সাধারনত কুষ্ঠ রোগে মৃত্যুর হার অত্যন্ত কম। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা সাধারনত রোগের ধরণ, মাত্রা, রোগীর বয়স ইত্যাদি কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে প্রধানত দুইভাবে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা করা হয়। যেমন- দীর্ঘ সময় ধরে এন্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধ সেবনের মাধ্যমে অথবা ড্যাপসোন দিয়ে সারা জীবন ধরে চিকিৎসা। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে অনেক মানসিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।

সবশেষে
প্রতি বছর প্রায় ৪ হাজার নতুন কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। অপুষ্টি ও সচেতনতার অভাবেই এ রোগের প্রার্দুভাব বাড়ছে। সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমেই এই রোগের প্রতিরোধ সম্ভব। কুষ্ঠ কোন মরণব্যাধি নয়, এটিকে সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

শৈশব থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সেই কুষ্ঠ রোগ হতে পারে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মহিলাদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হন। এই রোগের ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধি অত্যন্ত ধীর বলে, জীবানু সংক্রমনের প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর পর আস্তে আস্তে রোগটি প্রকাশ পেতে থাকে। সাধারনত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে এ রোগ কম দেখা যায়। অপরদিকে, ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব একটু বেশি দেখা যায়।

শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের দেহে এ রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই রোগ নিয়ে আর কোন সংশয় নয়। সঠিক চিকিৎসায় কুষ্ঠ রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়। তাই, সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করতে হবে।

কুষ্ঠ রোগ কি? রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করনীয় কুষ্ঠ রোগ কি? রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করনীয় Reviewed by Dhuliyan City on 23:19 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.