সুমিত ঘোষ
মুর্শিদাবাদ জেলার আধুনিক শিক্ষা জগতের মানচিত্রে কাঞ্চনতলা জে. ডি. জে. ইনস্টিটিউশন একটি অন্যতম বিদ্যালয়। জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের স্থাপনার সময়ের মাপকাঠিতে বিচার করলে এই বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে প্রাচীনত্বের দাবি রাখে। প্রসঙ্গতঃ এই বিদ্যালয় জঙ্গিপুর মহকুমার দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিদ্যালয়।
বলাবাহুল্য, ধুলিয়ান-কাঞ্চনতলা এবং তৎসহ সমগ্র সামসেরগঞ্জ থানা এলাকার আধুনিক শিক্ষার সূচনা হয় কাঞ্চনতলা হাইস্কুল স্থাপনের মাধ্যমে। এর পূর্বে এই সমগ্র এলাকায় পাঠশালা বা নিম্ন বুনিয়াদী শিক্ষার প্রচলন থাকলেও প্রকৃত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ও ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয় এই ঐতিহ্যমন্ডিত বিদ্যামন্দির স্থাপনার পর। এই সময় নিকটবর্তী বিদ্যালয় বলতে ছিল পাকুড় রাজ স্কুল।
কাঞ্চনতলার জমিদারের প্রতিষ্ঠাতা জগবন্ধু রায়ের সু-পুত্র প্রজাবৎসল জমিদার ভগবতীচরণ রায় ১৮৯৭ সালে কাঞ্চনতলা জগবন্ধু ডায়মন্ড জুবিলী ইনস্টিটিউশন স্থাপন করেন। ১৮৯৭ সালে ইংল্যান্ডশ্বরী ভিক্টোরিয়ার ডায়মন্ড জুবিলী অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশেষ ঘটনাকে স্মরণ রেখে এবং পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে তৎকালীন জমিদার মহাশয় বিদ্যালয়টির এইরূপ নামকরণ করেন। বিদ্যালয়টি প্রথমে মাইনর স্কুল ছিল । পরে ১৯০৮ সালে উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালে মি: এস. আর. কারপেট্রিক এবং পরে মি: এ. ডি. স্মিটন নামে দুই সাহেব প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। প্রাথমিক ভাবে এই বিদ্যালয়ের বোর্ডিংয়ে ক্লাস শুরু হয়। পরবর্তী কালে এই মূল ভবনটির নির্মাণ হয়। বহু গুণী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে ও শিক্ষাদানে কালক্রমে এটি একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
ইংরেজ সাহেব থেকে শুরু করে অসংখ্য গুণী মানুষের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে কাঞ্চনতলার এই পবিত্রভূমি। হেমন্ত কুমার রায়, কবি নজরুলের দীক্ষা গুরু যোগীবর বরদা চরণ মজুমদার, শ্রীপতি ভূষণ দাস, বহুবল্লভ গোস্বামী, সৌরিন্দ্র নাথ রায়, নৃসিংহ প্রসাদ কালী, কার্তিক চন্দ্র চৌধুরী, নিহার কুমার চৌধুরীর, ব্যোমকেশ দাস, বসন্ত বাবু, শিবদাস ভট্টাচার্য, বেলাল হোসেন, তাজামুল হক, আবুল হোসেন সাহেব, গোপাল চন্দ্র নন্দী, নসিবুল্লা বিশ্বাস প্রমুখ মহান শিক্ষকরা জীবনভর তাঁদের শিক্ষা ও আদর্শে অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সাফল্যের সোপান রচনা করেছেন। ১৯৯৭ সালে শ্রদ্ধেয় রমজান আলি মহাশয় মহাসমারোহে এই বিদ্যালয়টির শতবর্ষ উৎযাপন করেছেন।
১২৩ বছরের পুরনো এই বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি আজ শুধুই স্মৃতি। বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি সম্প্রতি নিরাপত্তার কারণে ভেঙে ফেলা হয়। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই যুগান্তকারী। একদল শিক্ষিত মানুষ এই চরম সিদ্ধান্তের আগে বোধকরি সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন এবং নিরুপায় হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
কাঞ্চনতলা স্কুলের ১২৩ বছরের ইতিহাসে, অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কাঞ্চনতলা স্কুলের দিনগুলি আজও অমলিন ও মূল ভবনের স্মৃতি যেন এক ধ্রুবক। স্কুল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের আলগোছে স্মৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে কমবেশি সকলের মনন জগৎ কে ভারাক্রান্ত করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেকেই এই ভবনের স্মৃতিতে আবেগপ্রবণ হবেন। সারা বিশ্বব্যাপী কাঞ্চনতলার বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের স্মৃতিরমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে বয়সন্ধিকালের বা যৌবনের মণি-মুক্ত খুঁজে বেড়াবেন। কিন্তু জন্মালেই তো মৃত্যু অবধারিত। এ সত্যকে অস্বীকার করি কি করে ! সু-চিকিৎসার জন্য মৃত্যু বিলম্বিত হতে পারে কিন্তু অন্যথা হবে না।
কাঞ্চনতলা স্কুলের পুরোনো ভবন সম্পর্কে আরও একটা কথা না বলে পারছি না। এই ভবনটির বেশ কিছু অংশ মা গঙ্গার বুকে আগেই বিলীন হয়েছে। আজন্ম মা গঙ্গার সাথে এই মূল ভবনটির তিক্ত সম্পর্ক। বর্ষাকালে মা গঙ্গা প্রায় প্রতি বছরই এই ভবনটি গ্রাস করতে এসেছে আর ব্যর্থ হয়েছে। আর ভবনটি যেন শিখদের নবম ধর্মগুরুর তেগবাহাদুরের মত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে "শর দে দেঙে, পর শির না দেঙে"। কখনো হার মানে নি। আজ অবশেষে ভবনটির মৃত্যু অন্যভাবে হলো বটে কিন্তু মা গঙ্গা গ্রাস করতে পারলেন না। এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন।
কাঞ্চনতলার মূল ভবনের ধ্বংসাবশেষের দৃশ্য আমাদের প্রত্যেকের কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং অনাকাঙ্খিত। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন তাঁরা যেন ইট, কাট, ধুলো-বালির স্তূপে বন্দি আপামর ছাত্র-ছাত্রীদের শৈশব কে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। তা যে ভাবেই হোক না কেন .... নতুন প্রস্তাবিত ভবনের কোনো অংশ পুরোনো আদলে গড়ে বা সেই ধ্বংসাবশেষের শেষ স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে এক টুকরো বেদি গড়ে বা অন্য কোনোভাবে। কেননা এই প্রাচীন বিদ্যালয়টি আমাদের সকলের কাছে একটি উপাসনা গৃহেরও ঊর্ধ্বে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রাচীন এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বিদ্যালয়ের গৌরব অক্ষুন্ন রাখবেন এবং সেই বিষয়ে যত্নশীল হবেন বলে আশাব্যঞ্জক মনোভাব প্রকাশ করছি। কিন্তু জানি না কেন, বিমর্ষ হৃদয়ে নজরুলের একটি বিখ্যাত গানকে আশ্রয় করে মনকে সান্তনা দিচ্ছি.......
"এ কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে
এই তো নদীর খেলা (রে ভাই)
এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই
ফকীর সন্ধ্যাবেলা...."
#সুমিত ঘোষ।
#উৎসর্গ: কাঞ্চনতলার সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী।
#ছবি-প্রথম ঘোষ।
কাঞ্চনতলা জে. ডি. জে. ইনস্টিটিউশন" এর ১২৩ বছর পুরোনো ভবনের স্মরণে
Reviewed by Dhuliyan City
on
09:53
Rating:
Reviewed by Dhuliyan City
on
09:53
Rating:
No comments: