সুবে বাংলার বেড়া উৎসব ।।
নবাবী মুর্শিদাবাদের একটি অতীব ঐতিহ্যবাহী আলোক উৎসব ভাদ্র মাসের বেড়া ভাসান । চলতি বর্ষে এই অভিনব পরব পদার্পণ করছে ৩১৫ বছরে । সাধারণত ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এই উৎসব আয়োজিত হলেও, এবছর বিশেষ কারণবশতঃ সপ্তাহ খানেক এগিয়ে এনে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাৎসরিক বেড়া ভাসান । আদতে এই ‘বেড়া’ শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রচলিত বেড়া বা প্রাচীর সমার্থক নয় । এই ‘বেড়া’ মূলত ফারসি শব্দ, যার অর্থ দলবদ্ধ জলযান নিয়ে কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে অভিযান করা । ‘বেড়া’র মূল শব্দ ‘ভেলা’ । আঞ্চলিক উচ্চারণে এটি ‘বেড়া’ বলে প্রতীয়মান । ‘বেড়া’ আদপে কলা গাছ নির্মিত ভেলা’কে বোঝায় যে ভেলার কথা পড়েছি আমরা পুরাণ প্রসিদ্ধ বেহুলা লখিন্দরের রূপকথার গল্পে । ‘ভেলা’ মুর্শিদাবাদের বাগড়ি অঞ্চলে ‘ভুঁড়’ বলে পরিচিত, আবার ‘বেড়া’ শব্দের অন্য এক অর্থ নৌবহর ।
বেড়া ভাসান একটি সর্বজনগ্রাহ্য লোক উৎসব । নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওড় অধ্যুষিত এলাকার জনগণ জলের যে কোনো প্রকার অকল্যাণকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য জলের পীর বা দেবতা খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশ্যে বেড়া বা কলার ভেলা ভাসিয়ে থাকে । সামাজিক ও পারিবারিকভাবে যেমন, তেমনি ফকির সম্প্রদায়ের উদ্যোগেও পালিত হয় এই সার্বজনীন উৎসবটি ।
খোয়াজ এক আরবীয় জলদেবতা বা ফেরেস্তার নাম । প্রাক-ইসলামি যুগে সর্বপ্রাণবাদী চিন্তাধারা থেকে এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে । ১৩শ শতকে, তুর্কি শাসকদের মাধ্যমে খোয়াজ খিজির বঙ্গদেশে প্রবেশ করে এখানকার জনমানসে ক্রমশ স্থায়ী আসন লাভ করেন । মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার নবাব-নায়েব-নাজিমরাও ছিলেন তাঁর ভক্ত । মুকাররম্ খান, মুর্শিদকুলি খাঁ, সিরাজউদ্দৌলা ও মীর কাশিম মহাসমারোহে ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার ঢাকার বুড়িগঙ্গা এবং মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীতে ভাসিয়েছেন সুসজ্জিত বেড়া ।
লোকায়ত ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী বেড়াভাসান খোয়াজ-কেন্দ্রিক হলেও কোথাও তিনি এককভাবে পূজিত হন না; এমনকি কোথাও কোথাও তিনি অনুক্তও । ঢাকার মুন্সিগঞ্জে হিন্দু মেয়েদের ব্রতাচারধর্মী পারিবারিক বেড়াভাসান উৎসবটি গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে উদ্যাপিত হয় । কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া পন্ডিতবাড়িতে যে বেড়া উৎসব হয়, সেখানেও খোয়াজ অনুপস্থিত; যদিও অনুষ্ঠানটির ‘জিন্দাপীর ও পরাণ ফকিরের বেড়া উৎসব’ রূপে নামাঙ্কিত । এখানে পাঁচজনকে স্মরণ করা হয় , প্রথমজন আদ্যাশক্তি গুহ্যকালী এবং অপর চারজন ফকির মুশকিন । এ উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের তমালতলায় পূজিত হন আটজন: প্রথম স্থানে মহাগুরু, দ্বিতীয় স্থানে খোয়াজ খিজির । বেড়া উৎসবের সময় খোয়াজ এবং গঙ্গার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা আছে একটি বেড়াভাসান গানে । এর মধ্য দিয়ে দুই সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনের একটি আন্তরিক প্রয়াস লক্ষিত হয় । বেড়া তৈরি করতে যে কলাগাছ প্রয়োজন তা সংগ্রহের জন্য উপবাসী সেবাইত শিষ্যদের নিয়ে গাছের মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে কলাবাগানে যান, গাছের উদ্দেশ্যে করেন মিনতি: ‘মা গঙ্গা আর খোয়াজ খিজিরের বেড়া তৈরির জন্য সাতটি কলাগাছ চাই ।’ পরে এক এক কোপে সাতটি কলাগাছ কেটে নিয়ে তৈরি করা হয় ভেলা ।
লোকসমাজে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ বিশ্বাস করেন, ভাদ্রমাসের যে কোন বৃহস্পতিবার অথবা প্রচলিত ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বা ভাদ্রের যে কোন রবিবার বেড়া বানিয়ে মানতসহ নদীতে ভাসালে জলকেন্দ্রিক অমঙ্গল ও বিপদ থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব । এছাড়া নানান পার্থিব কল্যান প্রার্থনা করা হয় বেড়া’র নিকট । লোকধর্মের আবরণে লৌকিক আচার সমৃদ্ধ ‘বেড়া ভাসান’ উৎসবটি বছরের নির্দিষ্ট সময়তো বটেই, সমস্যা ও সংকটের সহসা উপস্থিতিতে বছরের যে কোনো সময়ই পালন করা যায় । কয়েকটি বিজোড় সংখ্যক কলাগাছ কেটে একত্রিত করে তার উপর বাঁশ ও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চারচালা একটি ঘরের মতো করে তৈরি করা হয় মসজিদ বা মন্দিরের আকৃতিবিশিষ্ট কাঠামো । এর পর কলাগাছের বাকল দিয়ে ছাউনি ও চতুর্দিক ঘিরে দেওয়া হয় । ফুল, লতা-পাতা, রংবেরং কাগজের ঝালর, জরির ঝালর দিয়ে তাকে সাজিয়ে তোলা হয় সযত্নে । চালাঘরের উপর চূড়ায় লাল, নীল, হলুদ, ও বেগুনি রঙের ত্রিকোণ পতাকায় এবং কোথাও চাঁদ তারায় সাজানো গোছানো যে খুদ্র জলযানটির দৃষ্টিনন্দন আঙ্গিকের প্রকাশ ঘটে সেটিই বেড়া, বেইড়া, বেরুয়া, বৈরা, ভেরা বা ভেলা বলে পরিচিত । রমণীয় এই জলযানের একদিক হাতির মুখের আদলে, অন্যদিক কুমীরের মুখ সদৃশ ।
বাংলার সুবেদার মুকাররম্ খানের শাসনকালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা’য় প্রচলিত হয় বেড়া উৎসব । মুর্শিদাবাদে, সুবে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর হাত ধরে ১৭০৪-এ প্রথম এই উৎসবের শুভ সূচনা হয় । সেকালে হজরত ইলিয়াসকে স্মরণ করার পাশাপাশি বন্যা ও দুঃখ-দুর্দশার হাত থেকে মুক্তি পাবার উদ্দেশে এই উৎসব পালিত হতো । ইতিহাসে দু’রকমের ব্যাখ্যা মেলে এই উৎসব প্রচলনের পশ্চাদপটে । এখানকার নবাবেরা জলপথে খাজনার অর্থসহ বিপুল ধনরত্ন নজরানা পাঠাতেন উত্তর ভারতে মোগল সম্রাটদের ঠিকানায় । সেই ধনরাশি অনেক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলদস্যুদের আক্রমণে খোয়া যেত মাঝপথেই । সে কারণে খাজনা পাঠানোর পূর্ব মুহূর্তে জলদেবতা খাজা খিজিরের কাছে মানত করা হত বেড়া উৎসর্গের মাধ্যমে । অপর ব্যাখ্যাটি হল, প্রায় প্রতি বছরই প্রবল বর্ষা ও ভাগীরথীর প্লাবনে মুর্শিদাবাদ ও সংলগ্ন অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ ও পশুর প্রাণহানি ঘটতো নিয়মিত, নষ্ট হতো ফসল ও ভূ-সম্পত্তি । তাই বর্ষার বিদায়ে ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ধনসম্পদ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কামনায় জলদেবতা খাজা খিজিরের কাছে প্রার্থনা জানানোর রেওয়াজেই এই সর্বধর্মীয় আচার । হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এতে অংশগ্রহণ করেন একযোগে ।
বেড়া ভাসান উৎসবে নারিকেল, দুধ, কলা, মিষ্টি, ধান, দূর্বা, নানা ধরনের ফল, ফুল সিন্নি, জোড়া কবুতর, খিচুরি, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপ জল ও সিঁদুর দিয়ে ভোগ সাজিয়ে রাত ৮ টা থেকে ভোর ৪ টার মধ্যে বেড়া ভাসানো হয় । উৎসব কিছুটা নিয়ম-কানুন ও আচার ব্রত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । ইমামবাড়া থেকে সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা শুরু হয় সুললিত বজরা, আলোকসজ্জা, ব্যান্ড, তাসা সহকারে ওয়াসিফ মঞ্জিল পর্যন্ত । সেখানে ছোট নবাব ও নবাব পরিবারের বর্তমান বংশধরেরা ‘বেড়া’য় পরিয়ে দেন ‘সেহরা’ অর্থাৎ ফুলের মুকুট, পালিত হয় ভোগ নিবেদন পর্ব ‘নিয়াজ’ । এর পর ‘বেড়া’ নিয়ে শোভাযাত্রা ফিরে যায় ইমামবাড়া সন্নিহিত তোপখানা ঘাটে । ভাগীরথীর তীরে ৪০ ফুট লম্বা ও ৪০ ফুট চওড়া এক বিরাট কলার ভেলায় তোলা হয় প্রতীকী বজরা এবং অসংখ্য প্রদীপ ও আতসবাজিসহ বিভিন্ন কাঠামো । জ্বালানো হয় সোনা ও রুপোর প্রদীপ । পূর্বে ভেলায় সাতটি সোনার প্রদীপ থাকলেও এখন থাকে মাত্র একটি । ফল, সুজি, দুধ, ঘি দিয়ে তৈরি খাবার ‘রোট’ নিবেদন করা হয় জলদেবতার উদ্দেশ্যে । রাত ১১টা নাগাদ কেটে দেওয়া হয় ওই বিরাট ভেলার বাঁধন । মনোরম ভেলাটি জলে ভাসানোর পরপরই তুলে নেওয়া হয় সোনার প্রদীপটি । অবশ্য প্রজ্জ্বলিত অন্যান্য মাটির প্রদীপগুলি নিয়ে ভেলা ভাসতে থাকে আপন খেয়ালে । হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ছোট ছোট কলার ভেলা বানিয়ে তা ভাসিয়ে দেন নদীবক্ষে । ভেলা দুলকি চালে ভেসে চলে ভাগীরথীর বুকে । তোপখানা ঘাট থেকে ‘বেড়া’ যে মুহূর্তে বাঁধনছিন্ন হয়, ভাগীরথীর দু’পাড়ে শুরু হয় আতসবাজির বাহারি রংমশাল । দু’পাড়ে হাজার হাজার মানুষ চেয়ে থাকে মুগ্ধ নয়নে । হাজারদুয়ারির চোখ ধাঁধানো শোভার ক্যানভাসে ভেসে যায় স্বপ্নের আলোকবর্তিকা । প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয় প্রবহমান ভাগিরথীর তরল শরীর । বহু মানুষ নিজস্ব নৌকো বেয়ে ভেলার সাথে সখ্যতা রেখে এগিয়ে যান সেই মায়াবী আলোর টানে ।
বেড়া উৎসব যথার্থই এক সম্প্রীতির মিলনমেলা । উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত মেলাকে সাধারণ মানুষ ভালোবাসেন একান্তই নিজের করে । নানান জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে চারাগাছ বিক্রি এই মেলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য । জেলার বাইরে এবং দূর-দূরান্তের বহু গ্রাম থেকেও মানুষ আসেন হাজারে হাজারে । সম্প্রীতির উৎসব হিসেবে নবাব পরিবারও বেড়া’কে তুলে ধরতেন বরাবর । অতীতের জাঁক জমকের আকর্ষণে উপস্থিত হতেন বিভিন্ন প্রদেশের রাজা, জমিদার এবং সকল শ্রেণীর সাধারণ মানুষ আজকের মতোই । বেড়ার জৌলুস ও আলোকসজ্জা দেখে শুধু রাজা জমিদারেরাই নয়, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন তৎকালীন সময়ের ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন স্তরের আমলারাও । বেড়ার সেই গৌরব ধরে রাখতে আশির দশকে রাজ্য সরকারের বিচার বিভাগ ও মুর্শিদাবাদ এস্টেট এর যৌথ উদ্যোগে সন্বৎসর পালিত হয়ে আসছে বেড়া উৎসব । ভাবনার অভিনবত্বে সম্প্রীতির এই বেড়া’কে জেলাবাসী মনে করেন প্রাক-মহালয়া আরও এক দেব বোধন । মোঘল দিল্লীর অধীশ্বরদের নজরানা পাঠাবার অতীতের সেই নবাবী রেওয়াজ আজ মানুষের কাছে এক উৎসবে পরিণত, রাতভোর শতাব্দী প্রাচীন বেড়া উৎসব দেখার জন্য দেশ ছাড়িয়ে ভিনদেশী পর্যটকেরা এসেও ভিড় জমান, জেলা মুর্শিদাবাদের এহেন সম্প্রীতির আবহ এক অনন্য নজিরবিহীন ঘটনা, আক্ষরিক অর্থেই ।।
জাহির রায়হান
jahirraihann@gmail.com
তথ্য ও শৈলী ঋণ : মহঃ সামসুজ্জোহা ও মোমেন চৌধুরী ।
ছবি : সংগৃহীত ।
Reviewed by khokan
on
21:58
Rating:
No comments: