চিত্রশিল্পী এবং শিল্পগুরু
আচার্য নন্দলাল বসু (জন্মঃ- ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২ - মৃত্যুঃ- ১৬ এপ্রিল, ১৯৬৬)
তিনি ভারতের শাসনতন্ত্রের প্রথম সংস্করণের সচিত্র অলঙ্করণ করেন। তাঁকে ভারত সরকারের নকশা তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর অনুরোধে ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী সহ বিভিন্ন পুরস্কারের স্কেচ তৈরি করেন। ১৯৫২ সালে কাশী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিক ডিলিট. ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৬ সালে তিনি নয়া দিল্লীর ললিতকলা আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি কলাভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস পদ প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশীকোত্তম উপাধি এবং ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
নন্দলাল বসুর জন্ম জেজুর, তারকেশ্বর, হুগলি। বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র বসু। ছেলেবেলা থেকেই তিনি প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দেব-দেবীর মূর্তি সহ পুতুল তৈরি করতেন। চিত্রকলার প্রতি তাঁর আকর্ষন এবং পড়ালেখায় অমনোযোগীতার কারণে এফ, এ পরীক্ষায় পর পর দুবার ফেল করেন। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্যে কলিকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান। এখানকার ছাত্র থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহার প্রভৃতি ছবি এঁকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন।
তিনি কর্মজীবনের শুরুতে পাটনা, রাজগির, বুদ্ধগয়া, বারাণসী, দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হন। প্রায় একই সময়ে পুরী থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন এবং কোণারকের সূর্য মন্দির তাঁকে প্রভাবিত করে। ১৯২১ সালে তিনি বাঘ গুহার নষ্ট হয়ে যাওয়া চিত্রগুলি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ভগিনী নিবেদিতার হিন্দু-বৌদ্ধ পুরাকাহিনী বইটির অঙ্গসজ্জা করেন এবং ঠাকুর বাড়ির চিত্র কলার তালিকা তৈরীতেও সাহায্য করেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা সংঘে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৫-৩৭ সালে পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রসের বার্ষিক সম্মেলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করনও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন। তাঁর আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তাঁর প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। শেষ জীবনে নন্দলাল বসু তুলি-কালি এবং ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন এবং এক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে।
মৃত্যু
১৯৬৬ সালের ১৬ই এপ্রিল তিনি শান্তিনিকেতনে পরলোকগমন করেন।
পঞ্চাশ বছরের কিশোর গুণী নন্দলাল বসুর প্রতি
সত্তর বছরের প্রবীণ যুবা রবীন্দ্রনাথের আশীর্ভাষণ
নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,
জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।
অঞ্জন সে কী মধুরাতে
লাগালো কে যে নয়নপাতে,
সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা।
এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,
রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি।
যে মায়াবিনী আলিম্পনা সবুজে নীলে লালে
কখনো আঁকে কখনো মোছে অসীম দেশে কালে,
মলিন মেঘে সন্ধ্যাকাশে
রঙিন উপহাসি যে হাসে
রঙজাগানো সোনার কাঠি সেই ছোঁয়ালো ভালে।
বিশ্ব সদা তোমার কাছে ইশারা করে কত,
তুমিও তারে ইশারা দাও আপন মনোমত।
বিধির সাথে কেমন ছলে
নীরবে তব আলাপ চলে,
সৃষ্টি বুঝি এমনিতরো ইশারা অবিরত।
ছবির 'পরে পেয়েছ তুমি রবির বরাভয়,
ধূপছায়ার চপল মায়া করেছ তুমি জয়।
তব আঁকন-পটের 'পরে
জানি গো চিরদিনের তরে
নটরাজের জটার রেখা জড়িত হয়ে রয়।
চিরবালক ভুবনছবি আঁকিয়া খেলা করে,
তাহারি তুমি সমবয়সী মাটির খেলাঘরে।
তোমার সেই তরুণতাকে
বয়স দিয়ে কভু কি ঢাকে,
অসীম-পানে ভাসাও প্রাণ খেলার ভেলা-'পরে।
তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে,
নববালক জন্ম নেবে নূতন আলোকেতে।
ভাবনা তার ভাষায় ডোবা--
মুক্ত চোখে বিশ্বশোভা
দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে।
শান্তিনিকেতন , রাসপূর্ণিমা, ৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৮
..............................ন্মঃ- ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২ - মৃত্যুঃ- ১৬ এপ্রিল, ১৯৬৬)
তিনি ভারতের শাসনতন্ত্রের প্রথম সংস্করণের সচিত্র অলঙ্করণ করেন। তাঁকে ভারত সরকারের নকশা তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর অনুরোধে ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী সহ বিভিন্ন পুরস্কারের স্কেচ তৈরি করেন। ১৯৫২ সালে কাশী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিক ডিলিট. ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৬ সালে তিনি নয়া দিল্লীর ললিতকলা আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি কলাভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস পদ প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশীকোত্তম উপাধি এবং ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
নন্দলাল বসুর জন্ম জেজুর, তারকেশ্বর, হুগলি। বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র বসু। ছেলেবেলা থেকেই তিনি প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দেব-দেবীর মূর্তি সহ পুতুল তৈরি করতেন। চিত্রকলার প্রতি তাঁর আকর্ষন এবং পড়ালেখায় অমনোযোগীতার কারণে এফ, এ পরীক্ষায় পর পর দুবার ফেল করেন। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্যে কলিকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান। এখানকার ছাত্র থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহার প্রভৃতি ছবি এঁকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন।
তিনি কর্মজীবনের শুরুতে পাটনা, রাজগির, বুদ্ধগয়া, বারাণসী, দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হন। প্রায় একই সময়ে পুরী থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন এবং কোণারকের সূর্য মন্দির তাঁকে প্রভাবিত করে। ১৯২১ সালে তিনি বাঘ গুহার নষ্ট হয়ে যাওয়া চিত্রগুলি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ভগিনী নিবেদিতার হিন্দু-বৌদ্ধ পুরাকাহিনী বইটির অঙ্গসজ্জা করেন এবং ঠাকুর বাড়ির চিত্র কলার তালিকা তৈরীতেও সাহায্য করেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা সংঘে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৫-৩৭ সালে পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রসের বার্ষিক সম্মেলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করনও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন। তাঁর আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তাঁর প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। শেষ জীবনে নন্দলাল বসু তুলি-কালি এবং ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন এবং এক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে।
মৃত্যু
১৯৬৬ সালের ১৬ই এপ্রিল তিনি শান্তিনিকেতনে পরলোকগমন করেন।
পঞ্চাশ বছরের কিশোর গুণী নন্দলাল বসুর প্রতি
সত্তর বছরের প্রবীণ যুবা রবীন্দ্রনাথের আশীর্ভাষণ
নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,
জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।
অঞ্জন সে কী মধুরাতে
লাগালো কে যে নয়নপাতে,
সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা।
এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,
রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি।
যে মায়াবিনী আলিম্পনা সবুজে নীলে লালে
কখনো আঁকে কখনো মোছে অসীম দেশে কালে,
মলিন মেঘে সন্ধ্যাকাশে
রঙিন উপহাসি যে হাসে
রঙজাগানো সোনার কাঠি সেই ছোঁয়ালো ভালে।
বিশ্ব সদা তোমার কাছে ইশারা করে কত,
তুমিও তারে ইশারা দাও আপন মনোমত।
বিধির সাথে কেমন ছলে
নীরবে তব আলাপ চলে,
সৃষ্টি বুঝি এমনিতরো ইশারা অবিরত।
ছবির 'পরে পেয়েছ তুমি রবির বরাভয়,
ধূপছায়ার চপল মায়া করেছ তুমি জয়।
তব আঁকন-পটের 'পরে
জানি গো চিরদিনের তরে
নটরাজের জটার রেখা জড়িত হয়ে রয়।
চিরবালক ভুবনছবি আঁকিয়া খেলা করে,
তাহারি তুমি সমবয়সী মাটির খেলাঘরে।
তোমার সেই তরুণতাকে
বয়স দিয়ে কভু কি ঢাকে,
অসীম-পানে ভাসাও প্রাণ খেলার ভেলা-'পরে।
তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে,
নববালক জন্ম নেবে নূতন আলোকেতে।
ভাবনা তার ভাষায় ডোবা--
মুক্ত চোখে বিশ্বশোভা
দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে।
শান্তিনিকেতন , রাসপূর্ণিমা, ৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৮
..............................
সংগৃহীত
Reviewed by Dhuliyan City
on
22:09
Rating:
No comments: