পুণ্যতোয়া মা গঙ্গার সর্বগ্রাসী রূপ,সুমিত ঘোষের লেখা।

পুণ্যতোয়া মা গঙ্গার সর্বগ্রাসী রূপ
সুমিত ঘোষ

গঙ্গা নদীর দীর্ঘ গতি পথের শেষ পর্যায়ে ধুলিয়ান শহরের অবস্থান । ভৌগোলিক কারণে 'ধুলিয়ান' নামক শহরটির সামাজিক, অর্থনৈতিক শরীরী অবস্থা আজন্ম কাল মা গঙ্গার মেজাজের উপর নির্ভর করে আসছে। সত্তরের দশকে ফরাক্কা বাঁধ  স্থাপনের পর গঙ্গা নদীর জল নিয়ন্ত্রণ করা হলেও,     বাংলাদেশ অভিমুখে, স্বাধীন ভারতের একমাত্ৰ পৌর এলাকা ধুলিয়ান শহর তৎসহ গঙ্গা নদীর উভয় তীরের এলাকা আজও কিন্তু একই ভাবে প্রকৃতির খেয়াল খুশির শিকার হয়ে চলেছে। প্রকৃতির এই তান্ডব লীলা খেলায় আমরা "কাঠের পুতুল মাত্র"। গঙ্গা নদীর খেয়াল খুশিতে আমাদের জীবন গাঙে ঘটেছে কত উত্থান পতনের গল্প। "পুণ্যতোয়া গঙ্গার সর্বগ্রাসীরূপ" তাই হয়তো  প্রতিপাদ্যের বিষয় ।

গঙ্গা নদীকে মূর্তিস্বরূপ বিবেচনা করলে, তিনি এক হিন্দু দেবী। হিন্দুধর্মে এই দেবী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারিণী। তিনি বিভিন্ন ভাবে পূজিত হন । সম্ভবত "গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা" এই প্রবাদটি, এই বিশেষ দেবীকে  পুজোর প্রচলনের জন্যেই বাংলা ভাষায় সংযোজিত হয়েছে। যাইহোক, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন গঙ্গায় স্নান করলে সমস্ত পাপ মুছে যায় এবং জীব মুক্তিলাভ করে। এই কারণে অনেকে আত্মীয়স্বজনের দেহাবশেষ বহু দূরদূরান্ত থেকে বয়ে এনে গঙ্গায় বিসর্জন দেন; তাঁরা মনে করেন, এর ফলে মৃত ব্যক্তির আত্মার স্বর্গলাভ হয়। গঙ্গার তীরবর্তী বহু স্থান হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী পবিত্র তীর্থভূমি। এর মধ্যে যেমন রয়েছে, হরিদ্বার বা বেনারসের মতো তীর্থস্থান , তেমনি রয়েছে ধুলিয়ান এর মত ভাঙ্গন প্রবণ ক্ষয়িষ্ণু শহর ।

নব্বই এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই শ্রীনন্দন তখন নবম আর দশম শ্রেণীর ছাত্র । সেই সময় আমাদের পড়াশোনার পাশাপাশি, জীবনের ধারাপাতে চলতো দৈনন্দিন নতুন নামতার সংযোজন আর বিয়োজন । পরিবারের অভিভাবকদের নির্দেশে আমাদের উপর অর্পিত হলো নতুন কাজের । ধূলিয়ানের গঙ্গা পারে মালদা জেলার বৈষ্ণবনগর থানার অন্তর্গত  শোভাপুর গ্রাম থেকে হাঁড়ি করে দুধ বয়ে আনার কাজ । শুরুর দিকে নৌকা পার করে দুধ আনার কাজটাই আমাকে বেশ উৎসাহিত ও রোমাঞ্চিত করত। এর একটা বিশেষ কারণ হলো, শোভাপুর গ্রামের অদূরে তার কাঁটা দিয়ে ঘেরা বাংলাদেশের সীমানা । কৈশোর জীবনে এর উপলব্ধি টা ছিল অন্যরকম । আদতে 'বাংলাদেশ' পরাধীন ভারতের একটা অংশ হলেও আমার কাছে এর গুরুত্ব ছিল অন্য রকম ।  আমার মনে হত আর যাইহোক বাংলাদেশ তো বিদেশি রাষ্ট্র । আমার কাছে তখন বাংলাদেশই ছিল ইংল্যান্ডের সমার্থক ।

এলাকার গোয়ালাদের, গঙ্গা মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো নিবিড়। দ্বিধা বা লজ্জা কোনোটি না করেই স্বীকার করছি, দুধ আনার সময় জন সমক্ষে মাঝ গঙ্গায় পবিত্র গঙ্গার জল আর  দুধের সংমিশ্রণ করার কাজটি আমাকে খুব অপ্রস্তুত করতো । কিন্তু অধিক লভ্যাংশের লোভ সংবরণ বা প্রয়োজনীয়তা, কোনোটিকেই উপেক্ষা করা যেত না। দুধ আর জলের সম্পর্ক আজও একই ভাবে অটুট । বিখ্যাত ছায়াছবি 'শোলে' র  বাসন্তীর কথায়, "ঘোড়া অগর ঘাস সে দোস্তি করলে, তো বেচারা ঘোড়া ক্যা খায়েগে।" জন সমক্ষে দুধে জল, না দেওয়ার জন্য বহু কৌশল অবলম্বনও করি। কিন্তু যা হয় "অতি চালকের গলায় দড়ি।" এই নিয়ে একটা ঘটনা বলি..... পার দেওনা পুর ঘাট থেকে বেশ দূরে  কিছু গোয়ালাদের বাসস্থান ছিল, বোধ করি আজও তারা আছেন । সেই খান থেকে ফেরার পথে নদীর ধার ধরে  কিছু পথ বালির উপর দিয়ে হেঁটে আসতে হতো । সেই দুধ, বাড়ি ফেরার আগেই নিপেন সাহার মিষ্টির দোকানে বিক্রি করে আসতাম। কাজেই দুধে জল মেশানোর  কাজটি মাঝ গঙ্গায় করে ফেলতাম। কিন্তু এই কাজটি করতে আমার ভীষণ লজ্জাবোধ হতো। তাই লোক লজ্জা এড়াতে গঙ্গাতীরের  জল গামছা দিয়ে ছেঁকে খুব নিপুণ ভাবে দুধে মেশানো শুরু করলাম ।  কিন্তু নিজের অজান্তেই একদিন নদীর তীরের বালিমিশ্রিত জল দুধে মিশিয়ে দিই। এরপর নিপেন সাহার দোকানের রঘু কাকার কাছে হাতে নাতে ধরা পড়ি । মিষ্টির দোকানে দুধ মেপে দেওয়ার সময় বালির কির কির আওয়াজ, বালির উপস্থিতির প্রমাণ হয়ে যায় । যদিও দুধের সাথে চিনির দ্রাব্যতার সহজ তথ্য ভুলে গিয়ে মিন মিন করে বললাম "কাকা দুধে চিনি পড়ে গ্যাছে", তাই এই কির কির আওয়াজ। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে "I was caught red handed".

শোভাপুর যাওয়ার জন্য কাঞ্চনতলা স্কুলের পূর্ব দিকে অবস্থিত নৌকো ঘাট থেকে নৌকায় উঠতে হতো। সেই ঘাট টি আজও বর্তমান। একশো বছর আগেও ধুলিয়ান থেকে স্টিমার বা লঞ্চ পরিবহনের ব্যবস্থা থাকলেও , আজ আর নেই । এর একমাত্র কারণ হলো গঙ্গা ভাঙ্গন । কাজেই বড় নৌকা বা ডিঙি ছিল পারাপারের একমাত্র মাধ্যম।

গঙ্গা নদীর সাথে আমার পরিচয় মূলত প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তির পর । কাঞ্চনতলা স্কুলে পড়ার সুবাদে বাড়ির চৌহদ্দি বা পাড়ার বাইরের জগৎ সমন্ধে জানার অবকাশ পাই।  ১৯৮৩ সালে এই স্কুলে  পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হই। এই সূত্রে গঙ্গা নদীর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। গঙ্গা নদীর তীরে এত বিশাল স্কুলে নিজেকে নিতে মানিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়। স্কুলের একাংশ গঙ্গা বক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতো । মনে হতো এই স্কুলটির পুরোনো বাড়িটি যেন বুক চিতিয়ে গঙ্গার করাল গ্রাস থেকে ধুলিয়ান শহর কে বাঁচানোর এক অসম প্ৰতিযোগীতা করে চলেছে ।গঙ্গার জল বাড়লেই ওই ঝুলন্ত অংশে ক্লাস হতো না। স্কুলের পেছন দিকটা তে একটা কুল  আর পলাশ  গাছ দুটোর ফুল -ফল সরস্বতী পুজোর আগমনী বার্তা দিত। দুঃখের বিষয় এই যে, কুল গাছটার কোনো 'কুল' ই আমার মতো শান্ত ভদ্র ছাত্রদের অত্যাচারে যৌবনের গন্ডি পার করে বার্ধক্যে পৌঁছাতে পারে নি। আমার সহপাঠী পার্থ, সুপ্রিয়, জ্যোতি, অপু, উত্তম, রাকেশের অত্যাচার এই কুল গাছটি মরমে মরমে অনুভব করেছিল । শ্রাবণ ভাদ্র মাসে আমরা কুল গাছের ডাল , গঙ্গার জলের উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র বা দন্ড হিসেবে ব্যবহার করতাম । গঙ্গার জল  বাড়ল কিনা এই নিয়ে ছিল আমাদের কৃত্রিম দুশ্চিন্তা । ছুটে গিয়ে হেড স্যার শিব বাবুর(স্বর্গীয় শিবদাস ভট্টাচার্য্য) কাছে গিয়ে খবর দেওয়ার একটা নিষ্ফল চেষ্টা চলতো অহরহ । আসলে গঙ্গার জল বাড়লে স্কুল ছুটি হওয়ার একটা অপ্রত্যাশিত সম্ভাবনার সুযোগ কে কাজে লাগানোর প্রয়াস । কৈশোরে বৃহত্তর স্বার্থ অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর শ্রেয় ছিল। কিন্তু রাশভারী শিববাবুর সামনে বাকরুদ্ধ হয়ে ফিরে আসা ছাড়া কোনো গতি ছিল না । তবে বহুবার গঙ্গার জল বেড়ে যাওয়ার কারণে স্কুল বন্ধ থাকতো ।

আমাদের স্কুলের সামনে একটা অদ্ভুত দন্ত চিকিৎসালয় আমাকে খুব আকৃষ্ট করত। যতদূর মনে পড়ে, সেটা ছিল লাছনা ডাক্তারের দাঁত সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের ডাক্তারখানা। মূলত গঙ্গা পাড়ের মানুষ এখানে দাঁতের চিকিৎসা করতে আসতেন। দাঁত তোলাও যে একটা চিকিৎসা, সেটা আমার জানা ছিল না।  দাঁত তোলার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির আকার ও ব্যবহার  এবং দাঁত তোলার কৌশলে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। তখন কার ধুলিয়ান বাজারে তিনিই হয়তো একমাত্র দন্তচিকিৎশক ছিলেন কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে বহু মানুষ তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন , এই বিষয়ে সন্দেহ নেই।

গঙ্গার জলের স্রোতে নদীর কূল ও তৎসহ বাড়ি ঘর, মন্দির-মসজিদ নদীর জলে বিলীন হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটত । এই ঘটনা এক বার বিশেষ ভাবে মনে প্রভাব ফেলেছিল। তখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, কেউ যেন ক্লাসে এসে খবর দিলো যে সেলিমদের বাড়ি গঙ্গার জলে ভেঙে পড়েছে । আমরা বন্ধুরা সবাই ছুটে গেলাম সেখানে। দিন কতক আগে যে বাড়িটার উঠোনে বসে ঈদের সামাই আর মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম, সেই বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।  গঙ্গা তাঁর সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে একটা পাড়ার কিয়দংশ গ্রাস করেছে। বহু মানুষের কাঁচা পাকা বাড়ি গঙ্গা গর্ভে বিলীন হয়েছে। দিশেহারা সেলিমের পরিবারের  মতো আরো অনেক পরিবারও মাথা গোঁজার চাল এবং স্বজন হারানোর শোকে তখন বিহ্বল ।  কিশোর সেলিম মা গঙ্গার পানে চেয়ে তার সর্বক্ষণের খেলার সাথী ছোট্ট ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়ার করুণ আর্তি জানাচ্ছে।   এই ঘটনার কয়েক বছর পর আমাদের বাড়ির মাটির ঘরগুলো যখন বন্যায় সলিল সমাধিস্থ হলো, তখন বুঝলাম গৃহহীন শব্দটির প্রকৃত অর্থ।

শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের ঘোর বর্ষার সকালের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা । আমরা দুই ভাই খালি পায়ে একটা ডিঙি নৌকায় গিয়ে বসলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভীত ছিলাম বটে কিন্তু মনে মনে ভাবলাম,  "সাঁতার তো জানি, ঝড় উঠলে অন্ততঃ পক্ষে  সুকুমার রায়ের  সৃষ্ট চরিত্র 'বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই' এর মত দুরবস্থা হবে না ! বড়জোর দুধের হাঁড়ি উল্টে দিয়ে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশের কোনো অজানা ঘাটে গিয়ে ঠেকব । এসব এলোমেলো কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে কখন মাঝ গঙ্গায় পৌঁছালাম বুঝতেই পারিনি । প্রবল বেগে ঝড় বৃষ্টি ধেয়ে এলো । প্রকৃতির এই দুর্যোগ যেন
Thomas Campbell র রচনায় স্পষ্ট.....
"By this the storm grew loud apace,
The water-wraith was shrieking;
And in the scowl of heaven each face
Grew dark as they were speaking."
আমাদের ছোট্ট ডিঙি নৌকা মাঝ নদীতে টলমল। আমরা দুই ভাই আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে ইষ্টদেবতা কে স্মরণ করছি। মুসলিম যাত্রীগণ আল্লাকে স্মরণ করছেন । মৃত্যুমুখে পতিত হলে মানুষ জাত ধর্ম ভুলে একে অপর কে আঁকড়ে ধরে। ডিঙি নৌকার যাত্রীরাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। ক্রন্দনরত আমার মতো ভীত সন্ত্রস্ত এক কিশোরকে মাতৃসম এক মুসলিম মহিলা সেই দিন সস্নেহে সাহস যুগিয়েছিলেন । সেইদিন মা গঙ্গা আমাদের প্রতি সদয় হয়েছিলেন । সৌভাগ্যক্রমে আমরা সেই যাত্রায় নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছই। কিন্তু সে স্মৃতি আজও অমলিন।
আজ বহু বছর পর মনে হচ্ছে ঐ দিন দুর্ঘটনায় আমরা যদি গঙ্গা গর্ভে বিলীন হয়ে যেতাম, তাহলে গঙ্গা পারের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী  কবি নজরুলের কবিতার কথা স্বগতোক্তি করে বলতেন....
"হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার" ।

সুমিত ঘোষ এর লেখা।

পুণ্যতোয়া মা গঙ্গার সর্বগ্রাসী রূপ,সুমিত ঘোষের লেখা। পুণ্যতোয়া মা গঙ্গার সর্বগ্রাসী রূপ,সুমিত ঘোষের লেখা। Reviewed by khokan on 11:32 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.