ধুলিয়ান গঙ্গা রেললাইন ও গঙ্গা ভাঙ্গন

গঙ্গা ভাঙ্গন আর ধুলিয়ান শহর পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত । গঙ্গা ভাঙ্গন ধুলিয়ানের  সামাজিক  ও অর্থনৈতিক জীবন ওতপ্রোতভাবে প্রভাবিত করেছে  । ধুলিয়ানবাসি গঙ্গা ভাঙ্গনের সাথে সাথে সামাজিক তথা অর্থনৈতিক অবক্ষয় থেকে প্রিয় শহরকে রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর হয়েছেন । পঞ্চাশের দশকে এই রকম একটি বিশেষ ঘটনার  সম্পর্কে  আমি আপনাদের অবহিত করছি ।


ধুলিয়ান বাজারকে কেন্দ্র করে বারহারওয়া-আজিমগঞ্জ-কাটোয়া (BAK) রেলপথ স্থাপনের কথা ইংরেজ সরকার উপলব্ধি করে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে । এই বিস্তীর্ণ এলাকায় রেল পথ নির্মাণের জন্য ইংরেজ সরকার এলাকাটির সার্ভে করার দায়িত্ব অর্পণ করেন  P.C. Sheridan, ট্রাফিক সুপারিনটেন্ডেন্ট ও  J. Robrtson, ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার উপর এবং তারা তাদের রিপোর্ট পেশ করেন 1904 সালে । রিপোর্টে এই অঞ্চলের এক বিস্তারিত বর্ণনা দেন । (এই সম্পর্কে বিশদ আলোচনা ধুলিয়ান ইতিবৃত্তে বর্ণিত আছে ) । প্রাথমিক স্তরে 137 কিমি দীর্ঘ এই রেলপথে সাতটি স্টেশন ছিল , এগুলো হলো (১)আজিমগঞ্জ জংশন, (২) আজিমগঞ্জ সিটি, (৩) জঙ্গিপুর রোড, (৪) সুজনীপাড়া, (৫) ধুলিয়ান গ্যাঞ্জেস, (৬) তিলডাঙ্গা ও (৭) বারহারওয়া জংশন। এর মধ্যে ধুলিয়ান থেকে বারহারওয়ার মধ্যে ট্রেন চলাচল করে 1911 সালের 19 শে জানুয়ারী এবং ধুলিয়ান- জঙ্গিপুর রোডের মধ্যে ট্রেন চলে 1913 সালের 31শে জানুয়ারী । অর্থাৎ ঐ বছরে ধুলিয়ান ও হাওড়ার মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন হয় । ধুলিয়ান রেল স্টেশনের নাম প্রথমে ধুলিয়ান ঘাট করার কথা বিবেচনা করা হলেও তা পরে  ধুলিয়ান গ্যাঞ্জেস নামকরণ হয় যা বর্তমান ধুলিয়ান গঙ্গা স্টেশন থেকে প্রায় 3-4 কিমি দূরে অবস্থিত ছিল।


1942-1958 সালের মধ্যে গঙ্গার ভাঙ্গনে BAK রেলপথের 13 কিমি রেলপথ বিচ্ছিন্ন হয় । পরবর্তী কালে নিমতিতা থেকে সাঁকোপাড়া পর্যন্ত রেলপথ নতুন করে নির্মাণ করা হয়। পঞ্চাশের দশকে এই রেলপথ গঙ্গা ভাঙ্গনের জন্য বার বার বন্ধ রাখতে হয়। এর মধ্যে ধুলিয়ান ও তিলডাঙ্গার মধ্যে রেল যোগাযোগ  30 শে সেপ্টেম্বর,1952 থেকে সাময়িক ভাবে বন্ধ থাকে । 1 লা জানুয়ারি, 1953 থেকে পুনরায় রেল চালু হয় । কিন্তু অতি বর্ষা ও গঙ্গা ভাঙ্গনের ভয়াবহতাকে রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রী সুরক্ষা নিরাপদ  নয় বলে মনে করেন । অতঃপর জুন, 1953 সালে আবার রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পরে । আবার কিছুদিন সাময়িক ভাবে রেল পথ খোলা হয় । সেই সময় রেলবোর্ড  এলাকার সার্ভে ও নতুন পরিকল্পনার জন্য 45000/-  ও  10000/- টাকা বরাদ্দ করেন । কিন্তু এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই 1955 সালের নিমতিতা স্টেশনের এক রেল আধিকারিক গঙ্গা ভাঙ্গনের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে 23 শে সেপ্টেম্বর এই পথে রেল চলাচলের বন্ধের নির্দেশ দেন । বন্ধ হয়ে যায় ধুলিয়ানের সাথে বহির্বিশ্বের রেল যোগাযোগ। River Research Institute of the Government of West Bengal ধুলিয়ান তৎসহ এলাকার গংঙ্গা ভাঙ্গনের পরিস্থিতি 10.09.1954 ও অক্টোবর, 1955 সালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।  রেলকর্তৃপক্ষ  নিমতিতা-তিলডাঙ্গার মধ্যে সরাসরি রেলপথ (Diversion) স্থাপন অথবা সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনের সাথে পাকুড়- ধুলিয়ান নতুন লিংক রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করার কথা বিবেচনা করেন ।


দীর্ঘসময় কেটে গেলেও রেলকর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। হতাশাগ্রস্ত ধুলিয়ানবাসি 1956 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমবেত ভাবে তৎকালীন রেলমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কাছে পত্র প্রেরণ করেন ।


ধুলিয়ান সেই সময় একটি গুরুত্ব পূর্ণ বাণিজ্যিক শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল । বিড়ি শিল্প ও পাট শিল্পের ক্রমাগত উন্নতি ধূলিয়ানবাসির মনে নতুন স্বপ্নের উদ্রেক করছিল । কিন্তু গঙ্গা নদীর খামখেয়ালি ভাঙ্গনে মানুষ অসহায় হয়ে পরে । রেলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতি গ্রস্ত হন । শুধু ধুলিয়ানবাসি নয় , উত্তর বঙ্গের মানুষ যারা ধুলিয়ান বা নিমতিতা হয়ে  সরাসরি উত্তরবঙ্গে যেতেন তারা নতুন সমস্যায় পড়েন । মানুষের স্বাভাবিক জীবনও বিপর্যস্ত হয়ে পরে । এমত অবস্থায় ধুলিয়ানের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এলাকার করুন অবস্থার কথা এবং সর্বোপরি রেলপথের স্থায়ী সমাধানে বদ্ধপরিকর হন । এই আবেদনের ভিত্তিতে ধুলিয়ান গ্যাঞ্জেস রেল স্টেশন গঙ্গা নদী থেকে প্রায় 3 কিমি দূরে ধুলিয়ান গঙ্গা নামকরন হয়ে স্থায়ী ভাবে পুনরায়  রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়,  যা আমরা বর্তমান রেল স্টেশন হিসেবে দেখতে পায় ।
যাঁদের বিশেষ উদ্যোগ আমাদের সমগ্র ধুলিয়ান বাসি আজও উপকৃত তাঁরা হলেন-------
(1) ধীরেন্দ্র নাথ রায়, পৌরপিতা, ধুলিয়ান পৌরসভা
(2) মনিন্দ্র নাথ পাল, সদস্য, WBPCC
(3) ডা. কালি কুমার গুপ্ত, কমিশনার
(4) আব্দুল হামিদ, কমিশনার
(5) রমেন্দ্র নাথ পাল
(6) শংকর রায়
(7) সত্যদেব গুপ্ত
(8) মোঃ গাফ্ফার
(9) গোকুলেন্দ্র মোহন চৌধুরী, ভগবতী চরণ ডিসপেনসারি
(10) বিনয় পদ মজুমদার
(11) রাইসুদ্দিন আহমেদ
(12) মোঃ মহসিন, কমিশনার
(13) শ্রীপতি ভূষণ দাশ
(14) হেমন্ত কুমার রায়
(15) ডা. নরেন্দ্র নাথ দাশ
(16) শের আলি মহলদার
(17) সত্যেন্দ্র নাথ সরকার
(18) লক্ষী নারায়ণ দাশ
(19) ডা. বিষ্টু পদ রায়চৌধুরী
(20) ডা. ঋষি রঞ্জন রায়চৌধুরী
(21) ইন্দ্র চন্দ্র মুখার্জি 
(22) ইন্দু শেখর সরকার
(23) সুগন চাঁদ জৈন
(24) চেভাজি লাল জৈন
(25) মহাবীর প্রসাদ জৈন 
(26) ইন্দ্র চাঁদ জৈন
(27) ধরম চাঁদ জৈন
(28) বীরেন্দ্র নাথ দাস
(29) লক্ষ্মী প্রসাদ
(30) সিকান্দার আলি বিশ্বাস
(31) মো. খাবিরুদ্দিন আনসারি
(32) আব্দুল রাজ্জাজ
(33) আব্দুল কাশেম বিশ্বাস
(34) সফর আলি বিশ্বাস (ধুলিয়ান সু ফ্যাক্টরি)
(35) গোবিন্দ চন্দ্র দাস ।


সুমিত ঘোষ



তথ্যসূত্রঃ (1) File No. 1R/12, 1904. PW .Deptt. Railway Br. Government of Bengal (2) File No. 56/W-4/51/7 Ministry of Railway, Government of India (Railway Br.) (3) Map of Dhuliyan in1917
Courtesy - Directorate of State Archives, Government of West Bengal & National Archives of India, Government of India.
SUMIT GHOSH.


সংগৃহিত :-  https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1869368639822962&id=100002495334119


সুমিত ঘোষ  আমার লেখা "ধুলিয়ান ইতিবৃত্ত" বইটি (প্রকাশ কাল 2008) অনেকেই হয়তো পড়েছেন । বইটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করি ধুলিয়ানের মানুষ  ধুলিয়ান সম্পর্কে জানতে যথেষ্টই আগ্রহী । পরবর্তী কালে কর্মসূত্রে দিল্লী তে থাকাকালীন সময়ে মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে গবেষণা করার সুযোগ পাই এবং ফলস্বরূপ আরো নতুন কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হই । তখন 'ধুলিয়ান ইতিবৃত্ত' র সংশোধিত সংস্করন প্রকাশনার কথা  মনস্থির করি কিন্তু সময়ের অভাবে তা আজও সম্ভব হয়নি । তাই ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় গণমাধ্যম কে বেছে নিয়ে কিছু কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি । পরবর্তী কালে অবশ্যই সেটা প্রকাশনার কথা মাথায় থাকবে । আশা রাখছি ধুলিয়ানের নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু নতুন তথ্য জানবে। )


ধুলিয়ান গঙ্গা রেললাইন ও গঙ্গা ভাঙ্গন ধুলিয়ান গঙ্গা রেললাইন ও গঙ্গা ভাঙ্গন Reviewed by Dhuliyan City on 23:07 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.