খুব সাবধানে পা ফেল সোনালী । আহা তোর ছটফটে স্বভাবটা কবে যাবে বাপু ! শ্বাশুড়ীমা একটু আদুরে স্বরে বকা দিলেন ওকে ।
শ্বাশুড়ি নয় মামনি বলে ডাকে সোনালী অর্কর মাকে ।
বিয়ের পরের দিন থেকে ছোটখাটো বিষয়ে মামনির সাথে মতবিরোধ হলেও সেভাবে ঝগড়া কোনোদিন হয়নি সোনালীর ।আসলে সোনালী খুব বেশি তর্ক করা পছন্দ করে না ।সামান্য ভুলচুক দেখলেও না দেখার ভান করেই থাকে । তাই সোনালী সকলের কাছে খুব বাধ্য মেয়ে বা বাধ্য বৌমা ।
মামনি যেদিন থেকে শুনেছে অর্ক বাবা হবে আর উনি ঠাকুমা সেদিন থেকে তো সোনালীর ওপর নিষেধাজ্ঞা বেড়ে গেছে ।এমনকি সোনালী কখন কি খাবে তাও ওনার কথা শুনে । ছেলে অথবা মেয়ে এই নিয়ে মামনির কোনো সমস্যা নেই ,ওনার কেবল একটাই কথা বংশের প্রথম সন্তান ,ওনার প্রথম ঠাকুমা ডাক শোনানোর মানুষটা যেন সুস্থ সবল হয় ।
বাবিন মানে অর্কর বাবার সাথে তো এবাড়িতে ঢোকার প্রথম দিন থেকেই মেয়ে বাবার সম্পর্ক ওর।
এই যেমন একটু আগে সোনালী বাবিনকে কানে কানে বলে এলো ,মামনি বিকেলের দিকে ছোট কাকিমার বাড়ি গেলে তুমি আর আমি চালতার আচার খাবো ।বাবিন হেসে বললো ,ওরে পাগলী বুড়ো হারে টক সইবে কেন ।
তবে তোর মামনিকে লুকিয়ে আচার খেতে তোকে আমি হেল্প করবো ।
অর্ক তো আগে অফিস ফেরত মার্কেট থেকে সোনালীর জন্য চিকেন স্যাতে বা ফিস ফ্রাই টাইপের স্নাক্স নিয়ে আসত ।এখনতো বাবা হবার আনন্দে সোনালীর পেটের মধ্যে পুরো ফ্রুট গার্ডেন বানাবার মতলব এঁটেছে । সত্যনারায়ন পুজোর মত এক ব্যাগ করে ফল আনছে আর সোনালীকে সেগুলো জোর করে খাওয়াচ্ছে মামনি ।
সন্ধ্যেবেলায় অর্কর কোলে মাথা দিয়ে সোনালী শুয়ে ছিল ।
অর্ক মাঝে মাঝেই এক্সাইটেড হয়ে গিয়ে সোনালীর পেটে কান রাখছে ।
বোকাটা জানেও না চারমাস কিছুই সেভাবে বোঝা যায়না ।বিয়ের পর সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে এসে কি করে যে সকলের সাথে মানিয়ে নেবে সেটাই ছিল সব থেকে আতঙ্কের বিষয় সোনালীর কাছে ।কিন্তু অর্কদের বাড়িতে এসে সোনালী দেখলো সকলেই ওকে মানিয়ে নিচ্ছে ।
নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই গর্ব অনুভব করছে সোনালী ।
অফিস থেকে সামনের সপ্তাহেই অর্ককে হায়দ্রাবাদ পাঠাবে এক সপ্তাহের জন্য ।হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে মাঝে মাঝেই ট্যুরে যেতে হয় ওকে ।
কিন্তু সোনালীকে এই অবস্থায় রেখে অর্কর মোটেই যেতে ইচ্ছে করছে না ।
মামনি অনেক বুঝিয়েছে ছেলেকে ,আমরা তো আছি ।
মামনির অনেকদিন আগে বাড়ি থেকেই হারিয়ে যাওয়া একটা একভরি সোনার হার কাল রাতেই আলমারীর একেবারে কোন থেকে পাওয়া গেছে ।
বছর দুয়েক আগে হারিয়ে যাওয়া হারটা হাতে পেয়ে মামনি আনন্দে সোনালীকে চুমু খেয়ে বলেছিলো ,আমার দাদুভাই বা দিদিভাই যেই আসুক সে খুব পয়মন্ত হবে রে ।
অর্কর ট্রলি ব্যাগটা গোছাতে গোছাতে সোনালী বললো ,সাতদিন পর তুমি যখন ফিরবে তখন কিন্তু আমাকে একদিন বাইরে ডিনার করাতে নিয়ে যেতে হবে ।
এসব হেলদি ফুড খেয়ে খেয়ে আমার মুখে চড়া পরে গেছে ।
প্রতিদিন রাতে অর্ক নিয়ম করে সোনালীর সারাদিনের খাওয়া দাওয়ার খবর নিচ্ছে।
পেনড্রাইভে একগাদা কমেডি মুভি ভরে দিয়ে গেছে ।
সোনালীর যেন কিছুতেই মন খারাপ না হয়।
এরমধ্যে একদিন সোনালীর বাবা মাও এসেছিলো ।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো সাতদিন ।আজ অর্ক ফিরবে ।
সোনালীর ভীষণ ইচ্ছে করছিল অর্কর ফেবারিট কোনো ডিস বানাবে কিন্তু কিছুতেই মামনি ওকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেবে না এখন !
অর্কর ফ্লাইটে ওঠার আগেই ফোনটা করেছিল ।
হঠাৎ বাবিন ড্রইংরুম থেকে চিৎকার করে উঠলো ,
সোনালী কিছু বোঝার আগেই মামনি বললো ,পেটের টাই অপয়া ,পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বাবাকে খেলো। মামনি পাগলের মত কি সব বলছে । অর্কর কলকাতাগামী প্লেনটা ক্র্যাশ করেছে ।
মৃতের তালিকা এখনো দেয়নি ।
সোনালীর ভাবার ক্ষমতা প্রায় শেষ ।
মামনি সোনালীর পেটে জোরে একটা ...দুটো ..কিল মেরে বললো ,মেরে ফেল এটাকে ।আমার ছেলেকে খেয়েছে ও । অপয়া ,অলুক্ষুনে ...
কঁকিয়ে উঠেছিল চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালী ।
ভিতর থেকে ভ্রূণটাও বোধহয় বলে উঠেছিল ওটা একসিডেন্ট ,আমি নিরপরাধ ।
তারপর ঠিক কি হয়েছিল সোনালীর আর জানা নেই ।শুধু যখন চোখ খুলছিলো ,তখন ও নার্সিংহোমের বেডে । চোখের সামনে অর্ককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও মনে হচ্চিল এটা শুধুই ওর স্বপ্ন।
বাবিন হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে সোনালীর কাছে ।উনি নিউজে যে প্লেন ক্রাশের খবর দেখেছিলেন সেটা অর্কর ফ্লাইট ছিল না ।ওরটা ছিল আরো ঘন্টা খানেক পরের ফ্লাইট । একপাশে মামনি দাঁড়িয়ে আছে । সোনালীর বাবা মা কাঁদো কাঁদো মুখে কোনের দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ।অর্ক ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছিলো ।
অর্ক বেঁচে আছে দেখে সোনালীর বন্ধ হয়ে থাকা নিঃশ্বাসটা বেড়িয়ে এলো ।অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো সোনালী ।
ভয় পেয়ে ওরা ওকে নার্সিংহোমে নিয়ে এসেছে ।
ক্লান্ত অথচ ধীর গলায় সোনালী নিজের বাবাকে কাছে ডাকলো ।এই প্রথম সোনালী নিজের মতামত জানালো ।
বাবা আমি তোমার সাথে বাড়ি ফিরতে চাই ।
আমি চাই না আমার সন্তান অর্কদের বাড়িতে জন্মাক ।
মামনি বললো ,আমাকে ক্ষমা করে দে ।
সোনালী তখন স্থির স্বরে বললো ,মামনি আজ যদি অর্ক ফিরে না আসতো তাহলে কিন্ত এই সন্তান সাড়াজীবন অপয়া বলেই পরিচিত হতো ।
যে প্লেনটা ক্র্যাশ হয়েছে ,তাতেও কিন্ত অনেক প্যাসেঞ্জার ছিল । হয়তো সেখানে কোনো গর্ভবতীর স্বামী ছিল না ।তাহলে কার দোষে ওটা ক্র্যাশ হলো বলতো ?
সবাই নিশ্চুপ চোখে তাকিয়ে আছে সদা শান্ত মেয়ে সোনালীর দিকে ।
আমি আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবো পয়া- অপয়ার তকমা ছাড়াই ।
অর্ক বললো ,তুমি সত্যি ওবাড়ি চলে যাবে ?
ঘাড় নেড়ে সোনালী বললো , হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া বা এক্সিডেন্টের ওপর যখন আমার সন্তানের জন্মমৃত্যু নির্ভর করছে তখন তো মা হয়ে আমাকে ভাবতেই হচ্ছে ।
সোনালী নার্সিংহোম থেকেই রওনা দিলো বাপের বাড়ির উদ্যেশে।
পিছন ফিরে মামনি ,বাবিন আর অর্ককে বলে গেলো ,ওকে সুস্থ ভাবে জন্ম দিয়ে তারপর হয়তো ফিরবো ।
জন্মগ্রহনের জন্য হেলদি ফুড নয় ওর একটা শিক্ষিত পরিবেশ দরকার অর্ক ।
যার এখনো নিজস্ব আকৃতিই গঠন হয়নি সে কি করে অন্যের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে ?
একটা আকৃতিবিহীন ভ্রূণ কি করে পয়া-অপয়া বিচারের মানদন্ড হতে পারে ??
তবুও সোনালী ফিরবে সন্তান কোলে নিয়ে তার জন্মদাতার ভিটেতে ,
হয়তো মঙ্গলশঙ্খ বাজবে এই বাড়িতে
,যেখানে একদিন চোখে না দেখেই তাকে অপয়া দুর্নাম দেওয়া হয়েছিল ,কিছুক্ষনের জন্য হলেও তার মৃত্যু কামনা করা হয়েছিল।
একদিন দেখা যাবে তারই বাবা ,দাদু ,ঠাকুমা ডাকে এই বাড়িটা প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে ।
( collected )
সমাপ্ত
Reviewed by Dhuliyan City
on
08:25
Rating:
No comments: